ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

৪৮ ঘণ্টার হরতাল চলছে

সংশোধিত ভূমি আইন নিয়ে পাহাড়ে উত্তেজনা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

সংশোধিত ভূমি আইন নিয়ে পাহাড়ে উত্তেজনা

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বার বার নানা প্রতিবন্ধকতা আঘাত হানছে। ফলে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রক্তের হোলিখেলা চলার পর ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠার পর সবুজের পাহাড়ে শান্তির যে আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বার বার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে। এবার নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সংক্রান্ত চলমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে গত ৬ অক্টোবর সংসদে যে আইন পাস হয়েছে তা বাতিলের দাবিতে বাঙালীরা মাঠে নেমেছে। বাঙালীদের পাঁচটি সংগঠন বৃহস্পতিবার থেকে দুই দফায় ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন শুরু করেছে। তবে এর আগেও কয়েক দফায় ভূমি আইনের কার্যকারিতার বিরুদ্ধে বাঙালীরা হরতাল, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে। এবার বাঙালীদের পাঁচটি সংগঠনের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে এই বলে যে, পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের মৌলিক অধিকারবিরোধী নতুন এ আইন বাতিল করা না হলে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটবে, যার জন্য সরকারই দায়ী থাকবে। উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) বিল ২০১৬ পাস হয়েছে, যা এখন আইনে পরিণত হয়েছে। সে অনুযায়ী বিদ্যমান আইনের প্রস্তাবনায় তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লিখিত পার্বত্য জেলা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য জনসংহতি সমিতি শব্দগুলোর পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এছাড়া পাসকৃত বিলে বিদ্যমান আইনের ধারা ৩-এর উপধারা ২-এর দফা (গ) উল্লিখিত সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ, পদাধিকারবলে শব্দগুলোর পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ বা তার মনোনীত একজন প্রতিনিধি শব্দ প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। সংশোধিত আইনে বিদ্যমান আইনের ধারা ৬-এর দফা (ক)-এর পরিবর্তে পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি শীর্ষক নতুন (ক) ধারার শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া দফা (খ)-তে উল্লিখিত আইন, রীতি ও শব্দগুলোর পরিবর্তে আইন, রীতি ও পদ্ধতি শব্দগুলো এবং দফা (গ)-এর পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলে ভাসা ভূমিসহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হয়ে থাকলে তা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি থেকে বেদখল হয়ে থাকলে তা দখল পুনর্বহাল শীর্ষক নতুন (গ) দফা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, শর্ত থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিকৃত ভূমি ও বসতভিটাসহ জলে ভাসা ভূমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্প এলাকা ও বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে উপধারা প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া নতুন আইন অনুযায়ী কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদানক্রমে স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ করার বিধান হয়েছে। সংশোধিত আইনে ৭, ৯ ও ১৮ দফা সংশোধন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬ রহিত করা হয়েছে। সংসদে এ বিল পাস হওয়ার পর থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালী জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমিকে কেন্দ্র করে। পাহাড়ে পাহাড়ী ও বাঙালীদের আঞ্চলিক সংগঠন এবং পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে পরস্পরবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ীদের দুটি সংগঠন জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের মধ্যে সংঘাত চূড়ান্ত রূপ নিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুন-খারাবির ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে বহু। মাঝপথে বান্দরবানে পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ যেটি এমএনপি (ম্রো ন্যাশনাল পার্টি) নামে পরিচিত সেটি আত্মসমর্পণ করেছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপহরণ, খুন, মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানা সহিংস ঘটনার পর থেকে তারা আত্মসমর্পণ করে সুস্থ ধারায় ফিরে এসেছে গেল বছর। কিন্তু রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করে রাখা জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের বিরোধের কোন অবসান ঘটার লক্ষণ নেই। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে। জনসংহতির সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এ শান্তিচুক্তি ও আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করে তাদেরই একটি গ্রুপ বেরিয়ে যায়। তারাই পরবর্তীতে ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) নামে নিজেদের পরিচয় দেয়। সঙ্গত কারণে পাহাড়ের ঘটনা নিয়ে শান্তিচুক্তি হলেও অশান্তি রয়েই গেছে। এছাড়া শান্তিচুক্তি সম্পাদনকারী জনসংহতি সমিতিও চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না হওয়ার অভিযোগ এনে বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচী পালন করে আসছে। সর্বশেষ নতুন করে উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বাঙালী জনগোষ্ঠী সদস্যদের মাঝে। উল্লেখ্য, তিন পার্বত্য জেলায় বর্তমানে বসবাসরত বাঙালীর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। আবার এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা প্রায় সমান। পাহাড়ে বাঙালীরা পাহাড়ীদের মতো অনেকে আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামল থেকে ব্যাপকভাবে বাঙালীদের বসবাস শুরু হয় পাহাড়ে। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাঙালীদের আধিক্য রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে ভূমি দিয়ে তাদের বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এদের সেটেলার নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। দীর্ঘ সময়জুড়ে অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন হওয়ার পর থেকে বাঙালীরা রয়েছে ভূমি হারানোর ভয়ে। গঠিত ভূমি কমিশনে উপজাতীয়রাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তার ওপর নতুন সংশোধনী আইন অনুযায়ী ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের একক আধিপত্য রহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাঙালীরা যে দাবি তুলেছে তাতে তারা স্পষ্ট করে বলছে, এ আইনে বাঙালীরা ভূমি হারাবে। যেহেতু কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য পাহাড়ী (উপজাতি), সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কখনও বাঙালীদের পক্ষে যাবে না। অপরদিকে, পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে নতুন আইনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত না জানালেও তারা এতে সন্তুষ্ট। কারণ, নতুন আইনে পাহাড়ীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। কমিশনেও তাদের একক আধিপত্য রয়েছে। সর্বশেষ ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের অভিযোগ বিবেচনায় এনে বিরাজমান ভূমির বিরোধ নিরসন করা হবে। এক্ষেত্রে ভূমি কমিশন আইনে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
×