ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

কাশ্মীর ও এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৫ অক্টোবর ২০১৬

কাশ্মীর ও এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি

বিদায়ের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সময়ে নেয়া পরিকল্পনা (চরাড়ঃ ঃড় অংরধ) বাস্তবায়নের শক্তিশালী সূচনার কৃতিত্ব নিয়ে যেতে পারলেন। তার আমলের অন্যতম কৃতিত্ব সাম্রাজ্যবাদী ছায়াযুদ্ধ (চৎড়ীু ডধৎ)। তা তিনি ছড়িয়ে দিতে পারলেন এশিয়ার এ অঞ্চলে। কাশ্মীর নিয়ে এ মুহূর্তে যা হচ্ছে তা এরই অংশ। মার্কিন শাসকগোষ্ঠী ও নীতি নির্ধারকদের যে অংশ বুশ প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেছিল, দু’হাজার আট ও বারোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার বিজয়ী হওয়ার পেছনে তাদের বিশেষ অবদান ছিল। প্রথম দফায় ছিয়াত্তর কোটি ডলার বা ছয় হাজার কোটির বেশি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় আটানব্বই দশমিক ছয় কোটি ডলার বা প্রায় উনআশি কোটি টাকা খরচ করে ওবামাকে তারা জিতিয়ে এনেছিলেন। এরা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধে আটকে থাকার সুযোগে চীন দ্রুত সারা বিশ্বে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এক দশকের মধ্যে ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে উন্নীত হয়েছে। দু’হাজার থেকে দু’হাজার বার সালের মধ্যে পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন বাণিজ্যের অংশীদারিত্ব যেখানে শতকরা উনিশ দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে নয় দশমিক পাঁচ ভাগে নেমে এসেছে সেখানে চীনের অংশীদারিত্ব দশ দশমিক দুই থেকে বেড়ে হয়েছে শতকরা বিশ ভাগ। বহুল প্রচারিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান’ এবং ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ নামে চীনের যে অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে চীনের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছানো ঠেকানো সম্ভব হবে না। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এই নীতি নির্ধারকরা মনে করেন চীনের প্রতি মনোযোগ না বাড়ালে একুশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্বে নিজের আধিপত্য ধরে রাখা কঠিন হবে। সুতরাং এ মুহূর্তে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভূরাজনীতি হচ্ছে ‘চীন ঘেরাও’ এবং একে ঘিরে এ অঞ্চলে তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা বেশ জোরেশোরে চলছে। ওবামা প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশাল ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল নিয়ে ওবামা দু’বার ভারত সফর করেছেন এবং দু’বারই একাধিক বাণিজ্য চুক্তি সই করেছেন। এ সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পরিষদে ভারতের সদস্যপদের দাবিকেও তিনি সমর্থন করেছেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং জন কেরিও ভারত সফর করেছেন। গত মাসে কেরি যখন ভারত সফর করছেন তখন ওয়াশিংটনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পানিকর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ সংক্ষেপে ‘লেমোয়া’ নামে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছেন। আরও দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের অনেক কারণের মধ্যে মূল কারণ হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের বেড়ে চলা ক্ষমতা ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে ভারতকে তার প্রয়োজন। বাংলাদেশও এ প্রয়োজনের বাইরে নয়। সুতরাং কোথাকার পানি কোথায় গড়াতে পারে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখার চেষ্টা থাকা ভাল। লেমোয়া চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এ চুক্তির ফলে একদিকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়বে অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হবে। অবিশ্বাস বাড়বে। মাস না পেরোতেই ভারত-পাকিস্তানের ভালনারেবল ভূখ- কাশ্মীর জ্বলে উঠেছে। চলছে হুমকি পাল্টাহুমকি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় চলছে একপেশে ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার। পাকিস্তানের অন্য অশান্ত অঞ্চল বেলুচিস্তানও নতুন করে ফুঁসছে। কিছুদিন আগে লন্ডনে বেলুচ ছাত্র সংগঠন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। চীনের সরকারী প্রচার মাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ এর এক আর্টিকেলে বেলুচিস্তানকে নতুন করে অশান্ত করার জন্য সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। চীনের অনেক স্বার্থ রয়েছে বেলুচিস্তানের সঙ্গে। খবর রয়েছে, ভারতের অরুণাচলে ক্ষেপণাস্ত্র এবং লাদাখে ট্যাঙ্ক মোতায়েনের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও গোপনে তিব্বতে সামরিক প্রস্তুতি বাড়াতে শুরু করেছে। অর্থাৎ ওবামার ‘পিভট টু এশিয়া’ নীতি বাস্তবায়নের জন্য এ অঞ্চল অশান্ত করার তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়াকে অশান্ত করতে বা এ অঞ্চলে যুদ্ধ সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক এবং সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়িয়ে দু’দেশে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা। কারণ ভূখ-, জনসংখ্যা, সামরিক শক্তি ও অর্থনীতির দিক থেকে এ অঞ্চলে এ দু’দেশের প্রাধান্য রয়েছে। এদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওঠানামার সঙ্গে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা জড়িত। তা নষ্ট করতে ছাইচাপা আগুন কাশ্মীর রয়েছে। একটু ঘি ঢাললে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা মুহূর্তের ব্যাপার। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব সেই ভারত ভাগের সময় থেকে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কারো ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্রিটিশরা নিজেদের পরিকল্পনামতো সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করেছিল। কাশ্মীর নিয়ে তারা যে চাতুরি করেছিল তার ফল আজও ভোগ করছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্র দুটো চাইলে এ সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারত। জাতিসংঘ সে উদ্যোগও নিয়েছিল। সে সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাতিসংঘকে কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তান কোন পক্ষে যাবে এ নিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি। কারণ, তিনি জানতেন এতে কাশ্মীর ভারতের হাতছাড়া হবে। এর পর জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক অন্য কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ আর নেয়া হয়নি। দু’দেশের শাসকশ্রেণীও হয়ত তা চায়নি। কারণ, এ টানাপোড়েনে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও শাসকশ্রেণীর বহুমুখী লাভ। এমন সাংঘর্ষিক অবস্থা বজায় থাকলে দু’দেশেই সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ে। তাতে অস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসায়িক দিকটি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যা হোক, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও তাতে জড়িয়ে পড়বে। কী ভাবে Ñতা আগেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং, উরি হামলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপট তৈরির শক্তিশালী পদক্ষেপ। আগামী মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর বিষয়গুলো নানাভাবে আরও স্পষ্ট হবে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আগের মতো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপ ঘিরেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা আবর্তিত হয়েছে। সে সময় ন্যাটো ছিল তাদের প্রধান যুদ্ধজোট। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোনঠাসা করতে এ জোট গঠিত হয়েছিল। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক জোট গঠন এবং এদেশগুলোসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যুদ্ধনীতি বাস্তবায়ন করেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে তখন বিশ্বময় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তাঁর। ডলার ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা। এখন সে অবস্থা নেই। এখন তাকে কৌশল বদলাতে হচ্ছে। এশিয়ায় তাদের মনোযোগের কেন্দ্র যেহেতু চীন; সুতরাং এ অঞ্চলের অস্থিরতা বাড়াতে চীন ঘিরে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটবে। চীনকে সরাসরি আক্রমণ নয় বরং যুদ্ধই আসছে চীনের দুয়ারে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এমন জটিল যে, সরাসরি যুদ্ধ করে একে মোকাবেলা করা কঠিন। যেমন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্সসহ আসিয়ানভুক্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও তারা ভাল সম্পর্ক রাখতে চায়। পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ইরান প্রস্তাবিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তাদের চাবাহার বন্দর যুক্ত করতে আগ্রহী। এ পরিস্থিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল হলো দুদিকে সম্পর্ক বজায় রাখা দেশগুলো যাতে তাদেরকে বেছে নেয় এমন অবস্থা সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশে দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করা। এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি- আমার সঙ্গে না থাকলে বিপদ বাড়বে। আর ঠিক এখানেই তারা আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে লেলিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই আইএস এখন ছড়িয়ে পড়ছে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে,অনেক দূরে। আইএস এমন এক সংগঠন যাতে রুশবিরোধী যোদ্ধা যেমন আছে তেমনি আছে চীনের উইঘুর মুসলিম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্সসহ বহু দেশের তরুণ। এটা মনে করার কারণ নেই যে, আইএসের ছড়িয়ে পড়াটা এমনি এমনি হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবেই এটা হচ্ছে। গত পাঁচ জুলাই ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পেন্টাগনের সামরিক সূত্রের উল্লেখ করে বলা হয়, অনেক আগে থেকেই তাদের ধারণা ছিল যে, মার্কিন অনুগত বাহিনীর হামলায় ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট নিয়ন্ত্রিত এলাকা সংকুচিত হতে থাকলে আইএস যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসী হামলা করবে। আসলে ধারণা নয়, আইএস নিয়ে তাদের পরিকল্পনাই এমন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা যে কত সুদূরপ্রসারী অনেকেরই সে সম্পর্কে ধারণা আছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের দিয়েই ছায়াযুদ্ধের সম্প্রসারণ ঘটবে।
×