ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবীণদের জন্য ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৪ অক্টোবর ২০১৬

প্রবীণদের জন্য ভাবনা

দেশে প্রবীণের সংখা বাড়ছে। তবে এটা এখনই আশঙ্কাজনক বলা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোন দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ প্রবীণ হলে ওই দেশকে বার্ধক্য বা বয়স্ক জনসংখ্যার দেশ বলা যেতে পারে। বর্তমানে দেশে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। ২০১১ সালের লোক গণনায় প্রবীণের সংখ্যা ছিল ১ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। সেই হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে তারুণ্যের জয়যাত্রা চলমান। তবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবীণের সংখ্যা আরও বাড়বে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য চিন্তাভাবনা ও করণীয়র অবকাশ রয়েছে বৈকি। বিষ্ণু দে-র একটি কবিতায় আছে, ‘বয়স হয়েছে ঢের, পেনশনই তো পঁচিশ বছর ...।’ প্রকৃতপক্ষে বয়স্ক বা প্রবীণ জনগোষ্ঠী, যে বা যারা সময়ের অমোঘ নিয়মে প্রায় অচল, চলৎশক্তিহীন, পরনির্ভরশীল, শেষ জীবনে তাদের ভরসা কেবল পেনশন, গ্রাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, গুচ্ছ বীমা ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে এ জাতীয় সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুব কম, মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। ফলে স্বভাবতই অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন। দেশে গত কয়েক বছরে নানাদিক থেকে মূল্যবোধের ভাঙ্গাগড়া ও অবক্ষয় শুরু হলেও পরিবার, ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিকতা এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। সন্তান যদি নিতান্তই উচ্ছন্নে না যায় তাহলে সে বয়োবৃদ্ধ মা-বাবাকে কষ্ট করে হলেও দেখে রাখে, ভরণপোষণ দেয়। তবে এই সুযোগ-সুবিধা কেবল অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও ধনীগৃহেই মেলে। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা, সেখানে প্রবীণদের অবস্থা করুণ ও শোচনীয়। এজন্য অবশ্য পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চেয়ে দারিদ্র্যই অপেক্ষাকৃত বেশি দায়ী। তবে এও সত্য যে, তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার অভিঘাতে আবহমানকাল ধরে লালিত পরিবার প্রথা ক্রমাগত ভেঙ্গে যাচ্ছে। চুরমার হয়ে যাচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ। অথচ দেশে উন্নত দেশের মতো রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা, যাতায়াত ও চিকিৎসা সুবিধা, বৃদ্ধনিবাস ইত্যাদি এখনও গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে যেটুকু হয়েছে তা খুবই নগণ্য। সে অবস্থায় রাষ্ট্র তথা সরকারকে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আরও ভাবতে হবে নিশ্চয়ই। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুস্থ ভাতাসহ সাশ্রয়ী মূল্যে চাল ও আনুষঙ্গিক কিছু কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। তবে তা খুবই অপ্রতুল এবং সবার কাছে পৌঁছে না। প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা কর্মসূচীও প্রায় নেই বললেই চলে। আবার সব প্রবীণই যে অসুস্থ, চলৎশক্তিহীন ও পরনির্ভরশীল এমনও নয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ওষুধপথ্যের প্রেক্ষাপটে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে, প্রায় ৭১ বছর। বিচারপতিদের অবসর বয়সসীমা ৬৭ এবং শিক্ষকদের ৬৫ বছর করা হয়েছে। সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। বাস্তবতা এই যে, তারপরও অনেকের শরীর স্বাস্থ্য-মন মোটামুটি সুস্থ ও অটুট থাকে, কর্মক্ষম তো বটেই। সে অবস্থায় প্রবীণের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক অবক্ষয় ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জনসচেতনা সৃষ্টি, যোগাযোগ ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুশীলনসহ নানাবিধ সৃজনশীল কাজকর্মে দেশব্যাপী সম্পৃক্ত করা যেতে পারে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে। হতে পারে এই সেবা সম্মানী বা অর্থের বিনিময়ে অথবা স্বেচ্ছাসেবামূলক। তারুণ্যের টগবগে উচ্ছ্বাস ও কর্মক্ষমতার সঙ্গে যদি প্রবীণদের মেধা-মনন-অভিজ্ঞতার সুচারু মেলবন্ধন ঘটে, তাহলে নিশ্চিতই উন্নয়নের গতি বাড়বে।
×