ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

সব্যসাচী বেঁচে থাকবেন আপন সৃষ্টিতে

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২ অক্টোবর ২০১৬

সব্যসাচী বেঁচে থাকবেন আপন সৃষ্টিতে

বাংলা ভাষার প্রিয় কবি ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২৬ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন কালজয়ী উচ্চারণ ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই...।’ বরেণ্য এ লেখকের মৃত্যুর সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে গোটা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। এই অন্যতম দিকপাল কবির প্রয়াণে আমাদের দেশের সাহিত্য অঙ্গনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটল। পঞ্চাশের দশকের এই কবি গত দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় বাংলা সাহিত্য ও নাটকে তার আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন। কাব্য রচনা ও নাটক লেখায় তার শক্তিমত্তা এবং অনুকরণীয় ভাষাশৈলী বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজেকে অনুকরণপ্রবণতা থেকে মুক্ত রেখে একান্তভাবে নিজেরই একটি ধারা এবং রীতির উদ্ভাবন করেছিলেন। কবিতা ছাড়াও সৈয়দ শামসুল হকের লেখার দ্যুতি ও সৃষ্টিশীলতার অভাবনীয় শক্তিমত্তা নাটক, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত রচনায়ও প্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘদিন পাঠকদের বিমোহিত করে রেখেছেন। সাহসী, স্পষ্টবাদী ও সত্যের প্রবক্তা এই সব্যসাচী লেখককে জাতি চিরদিন মনে রাখবে তার অনন্য প্রতিভার জন্য। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয় মন্দিরে। তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য কবি, ঔপন্যাসিক ও নতুন ধারার কাব্যনাট্যের রচয়িতা, অনুবাদক। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক ও অনুবাদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার ঈর্ষণীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই দেশবরেণ্য কবি পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছেন অনুপম রচনা সম্ভার। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তার অনবদ্য বিচরণ ও দুর্লভ রচনার অনুপম কৃতিত্বের জন্যই বহুমাত্রিক সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আর তাই তিনি সব্যসাচী লেখক হিসেবে খ্যাত। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরলদীনের সারা জীবন’-এর মতো কালজয়ী নাটক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবিতার ছন্দ পাঠকের মনকে নাড়া দিত। মৃত্যু কড়া নাড়ছিল তার জীবনের দরজায়। তবুও জীবন প্রদীপ নেভার পূর্ব পর্যন্ত সক্রিয় থেকেই দেহত্যাগ করেন এই সাহসী লেখক। সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মদিন পালন উপলক্ষে গঠিত উদযাপন কমিটির তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে কবি ‘আহা, আজ কী আনন্দ অপার’ শিরোনামে একটি সুন্দর কবিতাও রচনা করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফররত শোকাহত প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত কবির আত্মার প্রতি বিনম্র্র শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যই তার (প্রধানমন্ত্রীর) জন্মদিন উপলক্ষে আয়েজিত কর্মসূচী স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫০ সালে কুড়িগ্রাম থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৫৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে। পড়াশোনা শেষ না করেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করে এটাকে ব্রত হিসেবে নেন। তিনি বিবিসিতেও কাজ করেছেন। তার অনন্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ মাত্র ২৯ বছর বয়সেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এই বরেণ্য কবি একুশে পদকসহ আরও অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। গত এপ্রিলে ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান কবি। লন্ডনের রয়েল মার্সডেন হাসপাতালে ফুসফুসে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। বাঁচার আশা ক্ষীণ হয়ে এলে ডাক্তারদের পরামর্শে ১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তিনি কবির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনেরও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কবির মরদেহ ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় শহীদ মিনারে রাখা হয়। বিকেলে কবির মরদেহ জন্মস্থান কুড়িগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। কুড়িগ্রাম কলেজ মাঠে জানাজা শেষে মাঠের শেষ প্রান্তে তাকে সমাহিত করা হয়। বাংলা সাহিত্যচর্চার সর্বক্ষেত্রে বরেণ্য এই কবির ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সদর্প বিচরণ সম্পর্কেই এ দেশের মানুষ অবগত ছিল। ইংরেজীতে বক্তৃতা ও বলার ক্ষেত্রেও যে তিনি কতটা পারদর্শী তা বিদেশের মাটিতে বসে আমার প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার ওয়াশিংটন দূতাবাসে আমাকে প্রেস মিনিস্টার করে পাঠিয়েছিল। দূতাবাসে যোগদানের মাত্র পৌনে তিন মাসের মাথায় ১৯৯৭ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ওয়াশিংটন টাইমস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড কালচারাল কনফারেন্স’-এ অংশগ্রহণের জন্য আমি বাংলাদেশ থেকে ৮ সদস্যের একটি ডেলিগেশন নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলাম। বিশ্বের ১০৪টি দেশ থেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য প্রায় চার শতাধিক ব্যক্তি ওই কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ডেলিগেশনটির প্রথম নামটিই ছিল সব্যসাচী লেখক আমার প্রিয় কবি সৈয়দ শামসুল হকের। ডেলিগেশনে আরও ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বর্তমান প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল খালেক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি তাজ মোহাম্মদ। বিষয়টি অবতারণা করার মূল কথাটি হলো ওই কনফারেন্সে সব্যসাচী কবির পারফরমেন্স অন্যান্য দেশ থেকে আগত অংশগ্রহণকারীদের এতটাই বিমুগ্ধ করেছিল যে, কনফারেন্সের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত মাইকেল মার্শাল বছরখানেক পরে আমাকে আবার অনুরোধ করলেন এই বলে ‘শাহজাহান মিয়া, আগামী আরেকটি বিশেষ কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করার জন্য তুমি কি আবার সেই কবি হককে আনতে পার?’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, তার ইংরেজী বলার স্টাইল ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপনার পারদর্শিতা আমাদের বিমোহিত করেছিল। মন্তব্যটি শুনে গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য আরও একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় যোগাযোগ করি। কিন্তু প্রায় একই সময়ে পূর্ব নির্ধারিত অন্য একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লী যাবেন বলে তাকে আর ওয়াশিংটনে নেয়া যায়নি। এই ছিল আমাদের সবার প্রিয় সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×