ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

অভিমত ॥ পারমাণবিক বিদ্যুত ব্যবহারের বিশ্বচিত্র

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অভিমত ॥ পারমাণবিক বিদ্যুত ব্যবহারের বিশ্বচিত্র

বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যুগে পদার্পণের বিশেষত, রুশ ফেডারেশনের সার্বিক সহযোগিতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতায় পরিবেশবাদীরা কয়েকটি বিষয় ফোকাসে নিয়ে আসেন। যেমন, উন্নত বিশ্ব যখন পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করছে বা বিদ্যুত উৎপাদনের উৎস হিসেবে পারমাণবিক অপশনকে পরিত্যাগ করতে যাচ্ছে, তখন আমাদের দেশ বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন যে, পারমাণবিক প্রযুক্তি সেকেলে হয়ে গেছে, তাই উন্নত বিশ্ব আধুনিক হালনাগাদ প্রযুক্তির সঙ্গে বেমানান বলে এই প্রযুক্তি পরিত্যাগ করছে। বাস্তবতা কি তাই? বস্তুত, পারমাণবিক প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর এই প্রক্রিয়া চলমান। ৩০ বছর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে চেরনোবিলের পারমাণবিক দুর্ঘটনাও এখন অতীতের ভয়াবহতম দুর্ঘটনা বলে বিবেচ্য। আজকের বিশ্বে কোন পারমাণবিক রি-এ্যাক্টরে চেরনোবিলের মতো দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ রি-এ্যাক্টর বিজ্ঞানের এখন বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। চেরনোবিলের রি-এ্যাক্টরটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের। আর এখন বিশ্বের দেশে-দেশে স্থাপন করা হচ্ছে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর। বাংলাদেশের রূপপুরেও রুশ ফেডারেশনের সার্বিক সহযোগিতায় থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর স্থাপিত হতে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপত্তা ও দক্ষতার নতুন বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসছে চতুর্থ প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর। রি-এ্যাক্টর এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে উন্নীত হওয়া মানে রি-এ্যাক্টরকে দক্ষতা ও নিরাপত্তায় ঢেলে সাজানো। মনে রাখতে হবে, যে প্রযুক্তি যত জটিল ও সংবেদী সেই প্রযুক্তি ব্যবহারে অধিক সতর্ক হতে হয়। পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও পরমাণুবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা অতি মাত্রায় সতর্ক ও দায়িত্বশীল। আর এজন্যই ১৯৫৬ সালের ২৭ আগস্ট বাণিজ্যিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হলেও আজ পর্যন্ত মাত্র তিনটি উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আজকের পরিবেশবাদীদের কেউ কেউ চেরনোবিল দুর্ঘটনার অজুহাতে বিশ্ববাসীকে পরমাণু শক্তিবিহীন উন্নয়নের প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। বলছেন, নবায়নযোগ্য শক্তিই সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। বস্তুত, পরিবেশবাদীরা বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর পরমাণু ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন বা ব্যবহারের বিরোধিতায় এবং নবায়নযোগ্য শক্তির পক্ষে প্রচারে সভা-সেমিনারসহ যত রকম কর্মকাণ্ড করে থাকে, সেখানে ব্যবহৃত শক্তির যোগান নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস থেকে আসে কি না, তা হিসাব কষার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে : সৌরশক্তির ব্যবহারে রাজধানী ঢাকার অর্ধেক আলোকিত করতে পুরো ঢাকার আকাশকে ঢেকে ফেলতে হবে। ঢাকাবাসীরা নিশ্চয়ই ওই অপশন বেছে নেবে না। আসলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এর ক্রমবর্ধমান শক্তি চাহিদা পূরণে মিশ্র উৎস থেকে শক্তি উৎপাদনের নীতি গ্রহণই সমীচীন। এক্ষেত্রে একক কোন উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন নীতি টেকসই হতে পারে না। ৩০ বছর আগে সংঘটিত যে চেরনোবিল দুর্ঘটনা নিয়ে পরিবেশবাদীদের মাতামাতির অন্ত নেই, সেখানে আসলে কী ঘটেছিল-তা খানিকটা জেনে নিই। ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে চেরনোবিলে বিস্ফোরিত ওই রি-এ্যাক্টরটি ছিল চার নাম্বার রি-এ্যাক্টর। অর্থাৎ সেখানে আরও তিনটি রি-এ্যাক্টর ছিল। বস্তুত, বিস্ফোরিত রি-এ্যাক্টরটি যে বিল্ডিংয়ে, সেই বিল্ডিংয়েই বাকি তিনটি রি-এ্যাক্টরের অবস্থান; এবং সেগুলো যথারীতি সচল ছিল। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই তিনটি রি-এ্যাক্টর থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়েছিল। সঙ্গতকারণেই সেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক রি-এ্যাক্টর কর্মী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীসহ অনেকের যাতায়াত ছিল। কিন্তু তাদের কেউ তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছে- এই মর্মে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও কিসের ভিত্তিতে আমাদের পরিবেশবাদীরা প্রচার করছেন চেরনোবিল মৃত্যুকূপের স্থিরচিত্র হিসেবে এখনও টিকে আছে। এদিকে যে ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই দেশেই মোট বিদ্যুত চাহিদার ৪৯.৪০ শতাংশ পারমাণবিক উৎস থেকে আসে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিজ্ঞ পরিবেশবিদরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে চেরনোবিল প্রসঙ্গ টেনে আনেন, তা স্পষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের একশ’টি রি-এ্যাক্টর থেকে পৃথিবীর মোট পারমাণবিক বিদ্যুতের শতকরা ৩৩ ভাগ উৎপাদন করে থাকে। আর নিজেদের বিদ্যুত চাহিদার শতকরা ১৯.৪৭ ভাগ আসে পারমাণবিক উৎস থেকে। উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুত সরবরাহকারী দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ। শিল্পোন্নত ফ্রান্স তাদের মোট বিদ্যুত চাহিদার বেশিরভাগই পারমাণবিক উৎস থেকে পেয়ে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান যে আজ শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, তার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে পারমাণবিক বিদ্যুত। প্রাকৃতিক তথা খনিজ সম্পদে দরিদ্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে পারমাণবিক উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের মাধ্যমে তরতর করে উন্নয়নের শিখরে উঠে গেছে, তা যে কোন দেশের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ কোরিয়া আজ রুশ ফেডারেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক টেকনোলজি রফতানির প্রতিযোগিতায়ও অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন ২৭টি নিউক্লিয়ার রি-এ্যাক্টর থেকে ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করছে। সেখানে নির্মাণাধীন রয়েছে ২৪টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। ২০৩০ সালে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত পারমাণবিক উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে বিশাল অর্থনীতির এই দেশ। আমাদের প্রতিবেশী ঘনবসতিপূর্ণ ভারত ২০৩২ সালের মধ্যে ৬৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত পারমাণবিক উৎস থেকে উৎপাদনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের যেসব দেশ পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করছে, সেগুলো হলো : কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, স্পেন, বেলজিয়াম, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইরান, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, রুমানিয়া, সেøাভাকিয়ান রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। পরন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এমনকি তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছে। নতুন জেনারেশনের রি-এ্যাক্টর আসার ফলে পুরনো জেনারেশনের রি-এ্যাক্টর বদলাচ্ছে কোনো কোনো দেশ। বস্তুত, শক্তি ক্ষুধার্তের এই বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎ অপার এক সম্ভাবনার বারতা নিয়ে মানবসভ্যতার সামনে হাজির হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কতিপয় পরিবেশবাদী ও অদূরদর্শী মানুষ পারমাণবিক বিদ্যুতমুক্ত উন্নয়নের নামে মানুষকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক
×