ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আগুন সন্ত্রাসের হুকুমের আসামি খালেদারও বিচার হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আগুন সন্ত্রাসের  হুকুমের আসামি  খালেদারও বিচার হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

নিউইয়র্ক, ২২ সেপ্টেম্বর (বাসস) ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে আগুন সন্ত্রাসীদের বিচারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, আন্দোলনের নামে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারী এবং তাদের হুকুমের আসামিদেরও বিচারের সম্মুখীন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার রাতে স্থানীয় গ্র্যান্ড হায়াৎ হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের হত্যার বিচার চলছে, কাজেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সকল হত্যাকা-ের বিচার আমরা করব। আগুন সন্ত্রাসীদেরও বিচার বাংলার মাটিতে হবে।’ হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়াকেও একদিন বাংলার মাটিতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন রাজনীতিবিদ ভুল করলে তার ভুলের খেসারত কে দেবে। ট্রেন যদি চলে যায় তাহলে পরের ট্রেনের জন্য তো অপেক্ষা করতেই হবে। তিনি বলেন, এখন তারা (বিএনপি) আবার রাজনীতিতে স্পেস চায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে টানা ৯২ দিনের আন্দোালনের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, মানুষের জানমালের ক্ষতির জন্য যদি দেশীয় আইনে কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়, তো হতেই পারে। তাকে রাজনৈতিক মামলা বলা যায় কি- প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে স্পেস নয়, কৃত অপরাধের জন্য তাদের জেলে যাওয়া উচিত। তখন এ্যারেস্ট করা হয়নি, সেটাই তার ভাগ্য (খালেদা জিয়ার) । তবে একদিন এ অপরাধে খালেদা জিয়ার বিচারও বাংলার মাটিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রবাসীদের দেশের বিরুদ্ধে বিরোধী মহলের অপপ্রচার সম্পর্কে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যে যেই স্থানেই থাকেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরবেন। এটা করার জন্য আমি আপনাদের সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তাহলে আর কেউ আমাদের দেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে আর দেশের ভাবমূর্তিকে সঙ্কটে ফেলতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিত-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই প্রবাসজীবন কাটাতে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ করে বলেন, যখন বাংলার মাটিতে ফিরেছিলাম তখন এ প্রতিজ্ঞা নিয়েই এসেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বাংলার মাটিতে করব। আর মুক্তিযুদ্ধের সে চেতনাকে ফিরিয়ে আনব, যে চেতনাতে একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সে চেতনাতেই আবার আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি চাই বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আজ যে সম্মানজনক অবস্থানে বাংলাদেশ এসেছে সেখানে পৌঁছতে বারবার আঘাত এসেছে। কিন্তু সেখান থেকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যেন দেশকে গড়ে তোলার পথে আমরা আবারও দেশকে নিয়ে যাচ্ছি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে ভিন্নপথে ক্ষমতার পালাবদলের শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয় এবং দেশকে একাত্তরের উল্টোরথে চড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে ষড়য়ন্ত্র সেজন্য নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তিনি জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করেন। শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথকে রুদ্ধ করে এবং দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চলমান ২২ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে কারাগারে আটক সাড়ে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসলেও দিনকতক বাদেই তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে আসল ষড়যন্ত্রকারী জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান সেনা আইন ভঙ্গ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে এই খুনীদের পুরস্কৃত করে। যে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল, মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্স দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে এই জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ সংশোধন করে জিয়া তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে রাজনীতি ও দল করার সুযোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে জিয়া, এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।’ এ সময় তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির মহান সংগ্রামের খ-চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালীদের সঙ্গে বৈষম্য করা হতো, উচ্চপদে বাঙালী কর্মকর্তা ছিলেন অনেক কম। অথচ উৎপাদন ও রফতানি আয়ের সিংহভাগ পূর্ব পাকিস্তানে হতো।’ প্রধানমন্ত্রী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রশাসন এবং শিক্ষা-দীক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে বাঙালীদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘এ বৈষম্য দূর করে অধিকার আদায়ে জাতির পিতা ২৩টি বছর সংগ্রাম করেন, আন্দোলন করেন।’ দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ সরকারের প্রশাসনে এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালীরা উচ্চপদে আসীন হতে পেরেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত সাড়ে সাত বছরে আমাদের সরকার দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো, বিদ্যুত, গ্রামীণ উন্নয়ন, পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলসহ প্রতিটি সেক্টরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাপক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করেছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ০৫ শতাংশে উন্নীত এবং দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ৫ কোটি মানুষ নিম্ন আয়ের স্তর থেকে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের দেশে এক শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বিদেশীদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিদেশীদের পাশাপাশি আমি প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও আহ্বান জানাব এসব প্রতিষ্ঠিতব্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে। এতে ব্যবসার পাশাপাশি যে কোন সময় চাইলেই তারা মূলধন ফেরত নিয়ে ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়াসহ বিদেশীদের জন্য প্রযোজ্য সকল সুবিধা লাভ করবেন বলেও জানান। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর রজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের শহীদদের, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণআন্দোলনে শহীদ এবং যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলাভেনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এর পরেই স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সকলে একযোগে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী এ নাগরিক সবর্ধনায় যোগ দেন। এ সংবর্ধনায় যোগ দিতে নিউইয়র্কের বাইরে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে হাজারো আওয়ামী লীগ সমর্থক ও নেতাকর্মী সংবর্ধনাস্থল গ্র্যান্ড হায়াতে ভিড় করেন। শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার জন্য সংবর্ধনাস্থলের বাইরেও অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষমাণ ছিলেন।
×