ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

জিতেন্দ্র কুমার সিংহ

যবনিকা পর্বে ঘটকালি

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যবনিকা পর্বে ঘটকালি

সমাজ পরিবর্তনশীল-এটা ধ্রুবসত্য। মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্রমবিকাশ, বৈশ্বিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন, বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্ব সমাজের বিভিন্ন জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হবার মধ্য দিয়েই গ্রহণ-বর্জনের চাকায় আবর্তিত হয়ে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। বহু ক্ষেত্রে বিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে পরিবর্তন আনা ব্যতীত কোন উপায় থাকে না। আর সেই ক্রমবিবর্তনশীল ধারার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে কোন কোন পেশা সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ‘ঘটক’ মানে উপযুক্ত হিসেবে স্বীকৃত বয়সে একজন পুরুষের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোকের মধ্যে সামাজিকভাবে স্বীকৃত উপায়ে সার্বিক সম্বন্ধ স্থাপনকারী। সম্ভাব্য বর-কনের অভিভাবকরা এক সময় প্রায় শতভাগই ঘটকের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। এ কাজ সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে না। ‘ঘটক’ পুরুষ কিংবা স্ত্রী উভয়ই হতে পারে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় এ পেশা সমাজ থেকে বিলুপ্তপ্রায়। সম্পর্ক স্থাপনযোগ্য নারী-পুরুষের আইনসিদ্ধ মিলন ঘটানোকে বিবাহ বলা হয়। মানবসমাজে সম্প্রদায়গতভাবে আলাদা আলাদা বিবাহ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন রীতি রয়েছে। বৈদিক যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা প্রচুর ছিল। ‘সমন’ উৎসবের মাধ্যমে স্বামী নির্বাচনের অধিকার নারীর ছিল। এ উৎসবে পুরুষ ধনুর্বিদ, রথচালক, অশ্বারোহী, অস্ত্রচালক ও মল্লযোদ্ধা হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। নারীরা তা অবলোকন করে পছন্দমতো স্বামী নির্বাচন করতেন। পরবর্তীকালে এটাই ‘স্বয়ম্ভর’ প্রথা নাম ধারণ করে। জাতিভেদ প্রথা প্রচলনের পর নারী সেই অধিকার হারা হন। ‘অনুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ভিত্তিক বিবাহ প্রচলিত হয় এবং বিবাহের ধরন আট ভাগে বিভাজিত হয়। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য্য, প্রজাপত্য, অসুর, গন্ধর্ব, রাক্ষস ও পিশাচ নামের বিবাহের মধ্যে প্রথম চার প্রকার বিয়ে যখন প্রচলিত ছিল, তখন ঘটকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন ঐসব স্থলে পরের চার প্রকার প্রতিস্থাপিত বিধায় ঘটকালী পেশার এ দুর্দশা। এছাড়াও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার আশীর্বাদে প্রিন্ট ও ভার্চুয়াল মিডিয়ার দাপটে এটা টিকতে পারেনি। যাঁরা এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই প্রাপ্ত যৎসামান্য উপার্জন দিয়ে সাংসারিক কাজে ব্যয় করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এ দায়িত্ব উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছলদের হাতছাড়া হয়ে সচ্ছলদের কাছে চলে গেছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না। বর ও কনে উভয়ই স্ব-স্ব পছন্দমাফিক জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে নেয়। অনেক সময় অভিভাবক তাঁর পুত্র কিংবা কন্যার পছন্দকে আন্তরিকভাবে নিজের পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার কোন কোন সময় অনন্যোপায় হয়েই মেনে নিতে বাধ্য হন। তবে মজার বিষয় হলো এই-ঘটকালির মাধ্যমে যে বিয়েটা সম্পন্ন হয়, তা কোন কারণে বিচ্ছেদ হলে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মনে করত পূর্ব থেকে পারস্পরিক জানাজানি না থাকাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। কারণ কাগজে কলমে জরিপ না নিলেও চোখের অনুমানে প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা চলে পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাইরে আইনের মাধ্যমে যাঁরা বিয়ে করেছেন তাঁদের অনেকেই নানা ধরনের অশান্তিতে ভোগার কারণে আবারও কোর্টের মাধ্যমেই বিচ্ছেদ ঘটান কিংবা নীরবে সহ্য করেন। সাধারণভাবে মনে একটা প্রশ্ন জাগে যে, ঘটকালির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া বিয়েগুলোর কি বিচ্ছেদ ঘটে না? উত্তরে বলা চলে যায়, অবশ্যই ঘটে। তবে তুলনামূলকভাবে কম। তাই বলা যেতে পারে, পৃথিবীর আবর্তনের মতো এটাও সামাজিক আবর্তনের ধারায় পড়ে সুশৃঙ্খল ও পরিশুদ্ধভাবে কোন এক সময় ঘটকালি পেশা সমাজে আগের মতো চলে আসলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে
×