ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

কোরবানি ঈদের সময় ও তার অব্যবহিত পরে ঢাকাবাসীদের সামনে কয়েকটি বিষয় এসে দাঁড়ায়। যেমন, প্রথমেই থাকে হাজার হাজার পশু কেরবানির পর তার বর্জ্য অপসারিত হলো কিনা। ফাঁকা ঢাকায় বেড়াতে বেরিয়ে দুর্গন্ধের থাপ্পড় খেয়ে আবার ঘরের ভেতর সিঁধোতে হবে কিনা। দ্বিতীয়ত যারা ঢাকার বাইরে যান এটা তাদের জন্য প্রযোজ্য- ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফিরে সব ঠিকঠাক পাব কিনা। চোর এসে সব লোপাট করে নেয়নি তো! তৃতীয়ত, ঈদের অবকাশে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া মোটামুটি আনন্দময় হবে কিনা। ভিড়ের ভেতর বিনোদন লাভ অসম্পূর্ণ থাকবে কিনা। ঢাকা এখন দুই মেয়রের সেবা পাচ্ছে। দু’জনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবার গত ঈদের তুলনায় আরেক ধাপ উন্নত হয়েছে। এজন্য মেয়রদ্বয়কে সাধুবাদ দিতে হবে। তারা অবশ্য একটু বেশি বেশিই দাবি করেছেন স্বকর্মতৎপরতার সাফল্য বিষয়ে। সে যাক। এবারও ঢাকাবাসী তাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য বজায় রেখে খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ওপর কিংবা গ্যারাজে পশু কোরবানি দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের আহ্বানে তারা কান দেননি। এটা ভাবনার বিষয় যে বাঙালী দেশের বাইরে গেলে কোরবানির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশটির আইনকানুন শতভাগ মেনে নেয়। অথচ স্বদেশে শতকরা পাঁচ ভাগও মানতে নারাজ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঈদের ছুটিতে মন্দ ছিল- এমনটা পাগলেও বলবে না। সব মিলিয়ে ভালয় ভালয় কেটেছে ঢাকাবাসীর ঈদ। সড়কে যানজট নেই, পিলপিল করে পিঁপড়ার মতো রাস্তার দুই ধারে জনতার সারি নেই। এক কাপ কফি পানের জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজতে বেরুলে দেখা যায় তার বেশির ভাগই বন্ধ। খোলাগুলোতেও হাতে গোনা দু-চারজন গ্রাহক মেলে। এই হচ্ছে অবস্থা। আমরা বলতেই পারি- ঢাকার বর্তমান চিত্রটাই একটা মোটামুটি সুস্থ নগরীর চিত্র। দেশের সব সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক করে জনসংখ্যার চাপে পিষে ঢাকাকে পরিত্যক্ত নগরী আখ্যা দিতে না চাইলে অতিসত্বর বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা দরকার নিশ্চয়ই। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক ঈদের পরদিন ছুটি মেলে, তার পরের দিনই অনেককেই ছুটতে হয় কর্মস্থলে। এবার সেই দিনটি ছিল আবার সপ্তাহ ফুরোবার দিন বৃহস্পতিবার। সকাল সকাল সেদিন চালু হয়ে গেল মহানগরীর আরেকটি উড়াল সড়ক, মানে ফ্লাইওভার। আমার অফিস-কামরা থেকে ডানে ঘাড় ঘোরালেই এই উড়াল সড়কের ‘উড়বার’ জায়গাটি নজরে আসে। ঠিক তার সমান্তরালেই রয়েছে বিপরীত পথে আসার জন্য আরেকটি উড়াল সড়ক। সেটি অবশ্য এখনও চালু হয়নি। তাই এটি একপেশে হয়ে গেল। একমুখো না বলে ইচ্ছে করেই একপেশে বলছি। এই উড়াল সড়ক নির্মাণ শুরু হওয়ার পর এলাকাবাসীর বিড়ম্বনা শেষই হচ্ছে না। কয়েক বছর লেগে যাচ্ছে। তারপরও কোন এক দিকের (যেমন আগে হয়েছে উত্তর দক্ষিণ মুখ) চলাচল উন্মুক্ত করে দিতে সে দিকটির উভয় পাশের উড়াল সড়কই খুলে দেয়া যুক্তিযুক্ত। অনেকটা সময় লাগিয়েও যথাযথ কাজটি কিছুটা ঝুলিয়ে রাখা সমীচীন হয়নি। আট কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের নিউ ইস্কাটন-ওয়্যারলেস পর্যন্ত এক কিলোমিটার অংশের উদ্বোধন হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। গত ৩০ মার্চ ‘মগবাজার-মৌচাক সমন্বিত ফ্লাইওভার’ প্রকল্পে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ হলি ফ্যামিলি-সাতরাস্তা অংশ চালু হয়। ওই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) থেকে বলা হয়েছিল, মৌচাক-বাংলামোটর থেকে মগবাজার হয়ে মৌচাক পর্যন্ত উড়ালসড়ক চালু হবে জুনে। কিন্তু এর প্রায় তিন মাসের মাথায় চালু হলো এর অর্ধেক অংশ। বাকি অংশ মৌচাক, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, চৌধুরীপাড়া (রামপুরা) এবং শান্তিনগর চৌরাস্তার কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বরে। পুরো উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলে প্রতিদিন ৫০ হাজার মোটরযান এর ওপর দিয়ে চলাচল করতে পারবে বলে প্রকল্পকারী কর্তৃপক্ষ জানায়। কিন্তু উড়ালসড়ক পুরোপুরি চালু হলেও নিচের সড়কের দুর্ভোগ ঘুচবে কি না এলাকাবাসী বুঝতে পারছে না। যা হোক, অন্য কথায় আসি। নিউ ইস্কাটনের প্রান্ত থেকে গাড়ি উড়াল সড়কে উঠে মগবাজারের দিকে চলল; তারপর ওয়্যারলেস এলাকায় রাশমনো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে উড়ালসড়ক থেকে নামতেই বিড়ম্বনার সূত্রপাত। কারণ, এরপর মৌচাকের দিকে যাওয়ার এবং বিপরীত দিকের সড়ক এবড়োখেবড়ো। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে আছে অনেক স্থানে। কোথাও কোথাও পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্য একাকার হয়ে আছে। এটা অবশ্য গত শুক্র-শনিবারের চিত্র। উড়ালসড়কের কারণে সৃষ্ট নিচের সড়কগুলোয় জনদুর্ভোগ কবে মিটবে- সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে এলজিইডির কর্মকর্তারা বলেছেন, উড়াল সড়কের নিচের সড়ক মেরামতের দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। অন্যদিকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্প এলাকার সড়ক মেরামত করবে উড়াল সড়ক নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন নয়। বুঝুন অবস্থা। এখনও ছুটি ছুটি ভাব! টানা নয় দিন ঈদের ছুটি কাটানোর লোকের সংখ্যা কত? এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব আশা করা নির্বুদ্ধিতা। নয় দিনের পর দশম দিনে অর্থাৎ ঈদের পরবর্তী সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রবিবার বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত গাড়ির চাপ দেখেছি। বনানীর সিগন্যালে আটকেও থাকতে হয়েছে দীর্ঘসময়, এমনকি মহাখালী পর্যন্তও ছিল ভোগান্তি। তবু বলা যাচ্ছে না ঢাকা তার নিজস্ব ছন্দে ফিরেছে। রবিবারে এই কলাম লেখার দিন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ঈদ করতে যাওয়া মানুষের বড় একটি অংশ ফেরত আসেননি। বিশেষ করে কর্মজীবী নিম্ন আয়ের মানুষ কম ফিরেছেন। রবিবার সকালে রাজধানী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দুটি পয়েন্ট গাবতলী ও উত্তরা এলাকায় গণপরিবহনের সংখ্যা বেশ কমই ছিল। টানা সাতদিন বন্ধ রাখার পর উত্তরা-মতিঝিল রুটের একমাত্র এসি পরিবহন (বিআরটিসি) রবিবারেই চালু হয়। নগরে চলে এমন বেশ কিছু গণপরিবহন ঢাকার বাইরে যাচ্ছে ঈদের কারণে। ঢাকায় অবস্থানকারী মানুষ বাধ্য হয়ে এটা মেনে নিচ্ছেন। ফাঁকা ঢাকায় অটোরিক্সা চালক ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহন নিয়ে অভিযোগ ও ভোগান্তির শেষ নেই। কর্মস্থলে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে নানা গন্তব্যস্থলে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোটি মানুষকে একান্ত বাধ্য হয়ে ভিড়ে ঠাসা বাস-মিনিবাসের যাত্রী হতে হয়। যানজট ছাড়াও বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য যানবাহন থামানোর কারণে নিত্যদিন অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। যেসব নাগরিকের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা কিংবা তা রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য নেই অথচ বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও সময় বাঁচিয়ে গন্তব্যস্থলে যেতে চান, সমস্যাটা তাদেরই বেশি। কারণ ট্যাক্সি ক্যাব, অটোরিক্সার নিদারুণ স্বল্পতা। ঢাকা মহানগরীতে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার। এর মধ্যে বৈধ অটোরিকশা ১২ হাজার ৮৩০টি। প্রায় এক বছর হলো সরকার মিটার রিডিংয়ে ভাড়া নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে। নজরদারির জন্য রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে ফাঁকা ঢাকায় সিএনজিঅলারা আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। ফলে ভোগান্তি বাড়ে যাত্রীদের। উন্নত বিশ্বের কথা থাক, এশিয়ার দেশগুলো, বলা যেতে পারে পার্শ্ববর্তী দেশের শহরের মতো সুশৃঙ্খল ও পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে আজও গড়ে ওঠেনি। ট্যাক্সি এখানে সোনার হরিণ। সিএনজিচালিত অটোরিক্সাগুলো অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। যাত্রীর প্রয়োজন নয়, তারা দেখে নিজেদের সুবিধা। অথচ চাহিবামাত্র যাত্রীর গন্তব্য অভিমুখে গাড়ি হাঁকানো আবশ্যিক শর্তের মধ্যেই পড়ে। বৃষ্টি ও পশুর রক্ত! ঈদের দিন খুব সকাল থেকেই ঢাকায় প্রচ- বৃষ্টি। এই বৃষ্টির ভেতরেই পশু কোরবানি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানিতে পশুর রক্তধারা মিশেছে। এই সংবাদ মাধ্যমের অনলাইনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবর প্রকাশ করা হয়। এটাকেই ইস্যু করে তোলে এক শ্রেণীর মানুষ। এ নিয়ে হাফিংটনপোস্টে লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর রুমি আহমেদ। লেখাটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করে প্রিয় ডটকম। লেখাটির কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি : ‘ঈদের দিন বিকেলে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে দেখা যায় রক্তবর্ণের পানিতে ভরে আছে একটি রাস্তা। স্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমের অনলাইনে ছবিটি দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি একটি সংবাদ প্রচার করা হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার রক্ত নদী’। এরপর দুবাইয়ের খাকি টাইমসসহ আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও সংবাদটি প্রচার করতে শুরু করে। এরপর বিবিসি, মিরর, সিএনএন, এবিসি নিউজ, নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ, দ্য গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও সংবাদটি প্রচার করতে শুরু করে। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের অনলাইন এডিশনে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। ভারতীয় এবং পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমগুলোও তা প্রচার করতে শুরু করে। সকল সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত ছবি এবং ভিডিও ছিল ঢাকার শান্তিনগরের একটি এলাকার। কয়েক দশক ধরেই এ এলাকায় জলাবদ্ধতার ব্যাপক সমস্যা রয়েছে। পশু কোরবানির কারণে ঢাকার একটি ক্ষুদ্র অংশে বৃষ্টির পানিতে রক্ত মেশার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি ‘রক্তের নদী’ শিরোনামে সংবাদ হওয়ার যোগ্য নয়। ট্যাবলয়েড থেকে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর সবাই ‘হিট সাংবাদিকতার’ জন্য এটিকে কাভার করেছেন। টোপ ফেলে পাঠককে ওয়েবসাইটে ঢোকানোর জন্য ‘রক্তের নদীর’ মতো শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে তারা। ... ঢাকাকে নিয়ে ‘নিম্নমানের’ সংবাদ শিরোনাম করা হয়েছে যা আসলে হওয়ার ছিল না। আর এ ‘হিট সাংবাদিকতার’ জন্য মর্যাদাহানি হয়েছে বাংলাদেশেরও।’ ভাগ্যিস! ঈদের পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২ নম্বর ভবনে এক অগ্নিকাণ্ডের সূচনা ঘটেছিল। আগুন ক্রমে বেড়ে উঠছিল, এয়ারকুলারের কাছাকাছি চলে এসেছিল। দুই যুবকের তৎপরতায় বিপদমুক্তি ঘটে। তাদের কাছে বড় সাইজের মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছুঁড়ে দেয়া হয় ও সেগুলো থেকে পানি ঢেলে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতেও পারত। ওই সময়ে সেখানে ছিলেন কবি সৈয়দ তারিক। ছবি তুলে তার পোস্ট দেন তিনি ফেসবুকে। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ [email protected]
×