ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় বন্ধ্যত্ব ঘুচছে না

সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় ॥ সচল হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় ॥ সচল হচ্ছে না

মনোয়ার হোসেন ॥ তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় সচল হচ্ছে না সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় প্রকল্প। সম্প্রতি বলয়ের নক্সা চূড়ান্ত হলেও উনিশ বছরের বন্ধ্যত্ব ঘুচিয়ে শুরু হচ্ছে না বাস্তবায়ন পর্ব। কবে নাগাদ নক্সাটি পূর্ণাঙ্গরূপে চূড়ান্ত হয়ে কাজ শুরু হবে সে বিষয়েও নেই কোন আশাবাদ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বে থাকা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নের এলাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ চূড়ান্ত হওয়া নক্সাটি প্রায় দুই মাস আগে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে এখনও নেই কোন অগ্রগতি। মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজধানীকে সাংস্কৃতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার অংশ হচ্ছে এই প্রকল্প। সেই সঙ্গে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী বেশ কিছু স্থান ও স্থাপনা। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পকলা একাডেমিতে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও মাঝে ১৯ বছর কেটে গেলেও হয়নি বাস্তবায়ন। অবসান ঘটছে না দীর্ঘসূত্রতার। প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে তিনি বলেন, তিনটি মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে দেরি হচ্ছে। আশাবাদের কথা ব্যক্ত করে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, দীঘসূত্রতার অবসান শেষে প্রকল্পের নক্সা চূড়ান্ত হয়েছে। নক্সাটি দেখার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও পছন্দ হয়েছে। এই নক্সাটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা এখন আশাবাদী। সংস্কৃতি, গণপূর্ত ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সমন্বিত উদ্যোগে শীঘ্রই শুরু হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। প্রকল্পের নির্মাণকাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় কোন স্থাপনা না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং এই প্রকল্পের ভেতরে নতুন করে বড় ধরনের কোন স্থাপনা গড়া হবে না। এ বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প এলাকাজুড়ে থাকবে নান্দনিকতার ছোঁয়া। নানা ধরনের গাছপালায় সাজানো হবে পুরো এলাকা। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় প্রকল্পের চূড়ান্ত নক্সা অনুযায়ী শাহবাগের ফুলের মার্কেটটি নতুন করে বিন্যাস করা হবে। ফুলের বাজারের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য সেখানে একটি আধুনিক রেস্তরাঁ নির্মিত হবে। শাহবাগ থেকে স্থানান্তরিত হবে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। এছাড়া মুক্তিয্দ্ধু ও ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি স্থানই সংরক্ষণের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের বিনোদনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে প্রকল্পভুক্ত এলাকাকে। এই প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ১৯ বছরেও এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হওয়াটা খুবই হতাশাজনক। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী তিন মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় প্রধানমন্ত্রীর গ্রহণ করা প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর গুরুত্ব না দেয়াই প্রকল্প সফল না হওয়ার মূল কারণ। সচল হওয়ার পরিবর্তে থমকে আছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষের বিনোদন উপযোগী করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে পরিকল্পিত এই প্রকল্পের উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসেছে। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা দ্রুত এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয়। সব মিলিয়ে রাজধানীর ২৬টি স্থাপনা রয়েছে এই বলয়ের অধীনে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্মৃতি জাগানিয়া স্থাপনা নির্মাণ করবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিনোদন স্পট, ফোয়ারা ও শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট স্থাপনা নির্মাণ করবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রস্তাবিত সীমানার স্থাপনাসমূহের মধ্যে উত্তর পাশে রয়েছে রমনা পার্ক, রূপসী বাংলা হোটেল, ঢাকা ক্লাব, জাতীয় সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ ভবন ও শিশুপার্ক। উত্তর-পূর্ব পাশে থাকছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, অফিসার্স ক্লাব ও বেইলি রোডের নাটক সরণি। দক্ষিণ পাশে রয়েছে জাতীয় তিন নেতার মাজার, ঐতিহাসিক ঢাকা গেট, শিশু একাডেমি, কার্জন হল, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত তৎকালীন কলাভবন ও ঐতিহাসিক আমতলা। দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব। দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। পূর্ব পাশে অন্তর্ভুক্ত হবে শিল্পকলা একাডেমি ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তন । পশ্চিম পাশে থাকবে জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা অনুষদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি সৌধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ ও লাইব্রেরি, টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা ও বাংলা একাডেমি। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই শেখ হাসিনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর মাঝে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে এলে প্রকল্প চলে যায় হিমঘরে। এই জোটের ক্ষমতার মেয়াদ শেষে পরবর্তীতে দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও থমকে থাকে প্রকল্প। এরপর পুনরায় ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুনরায় প্রকল্পটির বিষয়ের আগ্রহ দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন টেবিলওয়ার্ক হলেও ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি বৈঠকে প্রকল্পটি নিয়ে কথা হলেও নেয়া হয়নি বাস্তবায়নের যথাযথ উদ্যোগ।
×