ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পরিচালনা পরিষদে আমলা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পরিচালনা পরিষদে আমলা

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে রাজধানীর তিন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমলাদের। আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানে তাদের বসানোর প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত প্রায়। ফলে কমিটির সভাপতি পদে আর স্থান পাচ্ছেন না স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীরা। যদিও ওই পদে আমলাদের বসানোর নির্দেশ দেয়নি আদালত। সিদ্ধান্তটি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের। এতে শিক্ষা প্রশাসনে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে। আমলাদের বসানোর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামার কথাও বলছেন সংক্ষুব্ধরা। নীতিনির্ধারকরা বলছেন আইন অনুযায়ীই এডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বলেন, ৩১ আগস্টের মধ্যে এই কমিটি করার বাধ্যবাধকতা ছিল। কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অনেকে মনে করেন জনপ্রতিনিধি বা এমপিদের সরিয়ে এভাবে যদি আমলাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সঙ্কট আরও বাড়বে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধারাবাহিক যে সাফল্য এসেছে তা ব্যাহত হতে পারে। তাদের বক্তব্য এমনিতেই পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে ভিন্ন মতের সরকারী কর্মকর্তাদের নেতিবাচক মনোভাবের কথা সবারই জানা, তারপরও এই ধরনের সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এ কথা সত্য যে, দেশে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির যথেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, কমিটির সভাপতি হিসেবে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দৌরাত্ম্যের কথা প্রচলিত। বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নগণ্য। বেসরকারী হাইস্কুল ও কলেজই বেশি। বেসরকারী হাইস্কুল ও কলেজগুলো পরিচালিত হয় শিক্ষা বোর্ড বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত কার্যকরী কমিটি ও পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক। এই কার্যকরী কমিটি বা পরিচালনা পরিষদের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করা। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই কমিটি বা পরিষদ নিয়ে শত অভিযোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের চেতনায় শিক্ষা-অনুরাগের বিষয়টি অনুপস্থিত। প্রশ্ন রয়েছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনেকের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে। অনেকে কার্যত নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সর্বময় হর্তাকর্তা মনে করেন। তাদের কাছে অবমূল্যায়িত হন শিক্ষকরা, তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে সায় না দিলে বা বাধা হয়ে দাঁড়ালে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত এমনকি চাকরিচ্যুত হতে হয়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি একজন এমপি কর্তৃক স্কুলের প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত ও অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা তার একটি নমুনা মাত্র। জনপ্রতিনিধিদের পদাধিকারবলে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার সুযোগ রহিত হওয়ার ফলে স্কুল-কলেজ পরিচালনায় সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা সীমিত হবে বলে অনেকের বিশ্বাস। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়। সত্যিকার যোগ্য-দক্ষ প্রকৃত শিক্ষানুরাগীদের দ্বারা কীভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে সরকারকে, সংশ্লিষ্টদের। আমলাদের কাছে যে দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে সেটা তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব। এমনিতেই সরকারের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের প্রচুর কাজ রয়েছে। সেই সব কাজ সম্পন্ন করে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতটুকু সময় দিতে পারবেন সেই বিষয়টিও ভাবা দরকার। এতে জনপ্রতিনিধি এবং আমলাদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে। আর সেটা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা ব্যবস্থা। ব্যাহত হবে সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রের সাফল্য। দেশে এমন বহু জনপ্রতিনিধি বা এমপি আছেন যারা উচ্চ শিক্ষিত এবং শিক্ষানুরাগী। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাদের একেবারে দূরে ঠেলে দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় শতভাগ সাফল্য নিশ্চিত করা কতটা যৌক্তিক সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তবে সব কথার শেষ কথা জাতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি করতে, মেধা-মননে সমৃদ্ধশালী ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। এ খাতকে সময়োপযোগী ও দুর্নীতিমুক্ত করা জরুরী। এ জন্য শিক্ষিত, শিক্ষানুরাগী, সংস্কৃতিমনা, সমাজ সচেতন ব্যক্তিদেরই এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া উচিত।
×