ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

মীর কাশেমের ফাঁসি ॥ জামায়াতের মূল স্তম্ভের ধসে পড়া

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মীর কাশেমের ফাঁসি ॥ জামায়াতের মূল স্তম্ভের ধসে পড়া

রিভিউ রায়ে মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রইল। দীর্ঘ অপেক্ষা, নানা শঙ্কা ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল শেষে কাক্সিক্ষত রায়টি এসেছে। সে জন্য জনমনে স্বস্তির আনন্দ। কথা হলো এই রায়টি নিয়ে এত আলোচনা, উৎকণ্ঠা বা সন্দেহের সূত্রপাত কেন? কারণ আছে। এই প্রথম রিভিউ রায়ে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে। একটু পেছনে ফিরে দেখি। ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় মীর কাশেমকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার। এক বছরের বেশি সময় ধরে মামলা চলে। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর ট্রাইব্যুনাল ২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মীর কাশেম আলীর ফাঁসি ও সর্বমোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এর পর ২০১৬ সালের ৮ মার্চ আপীল মামলার রায়ে একই দণ্ড বহাল থাকে। গত ১৯ জুন রিভিউ আবেদন করে মীর কাশেম আলী। দু’বার সময় পিছিয়ে ২৪ ও ২৮ আগস্ট রিভিউ শুনানির পর ৩০ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে চূড়ান্ত রায়টি হলো। অর্থাৎ ৪ বছরের বেশি সময় লেগেছে রায় দিতে। ‘পৃথিবীটা কার বশ? টাকার।’ আমাদের দেশে চালু এই আপ্তবাক্য মীর কাশেম আলীর চরম দণ্ড বহাল থাকা না থাকার বিষয়ে খুবই প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তার কারণও ছিল। জামায়াতের মূল অর্থ যোগানদাতা এই টাইকুন মীর কাশেম আলী। স্বাধীন বাংলাদেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ও সরকারী আনুকূল্যে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, দিগন্ত টিভি ছাড়াও আরও জানা-অজানা বহু অর্থ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এক বিশাল অর্থ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধী। টাকার ক্ষমতায় বেপরোয়াই ছিল এই নরাধম। তাই ২০১৪ সালের শেষে ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যখন ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ছিলেন, তখন মীর কাশেমকে কাঠগড়ায় দৃশ্যত ফুরফুরে মেজাজে দেখা গিয়েছিল। ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, ‘শয়তান শয়তান ... মিথ্যা ঘটনা ... মিথ্যা সাক্ষ্য ... কালো আইন ... ফরমায়েশি রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই শীঘ্রই।’ সে দিনের মতো ২৪ ও ২৮ আগস্ট রিভিউ শুনানিকালে আমি সুপ্রীমকোর্টের বিচারালয়ে ছিলাম। মীর কাশেমের প্রধান কৌশলী এ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেন কথাটি তুলেছিলেন এভাবে– বিপুল অর্থের মালিক দানশীল তার মক্কেল মীর কাশেম নিরপরাধ ছিলেন বলেই বিদেশে চলে যাননি। প্রকৃত সত্য হলো তারই বিপুল অর্থের মাধ্যমে প্রভাবিত করা বিভিন্ন দেশী-বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রের ওপর মীর কাশেমের আস্থা এতই প্রবল ছিল যে, তার কোন দণ্ড হবে বা হলেও তা গুরু দণ্ড হবে– এমন সম্ভাবনা সে কল্পনাও করেনি। হাওয়ার ওপর সে নির্ভর করেনি। দেশে-বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। তাই বিদেশে গিয়েও আবার দেশে ফিরেছে। সে হয়ত ধারণাও করতে পারেনি যে, দেশে ফিরে আসার পর তার বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে, সে গ্রেফতার হবে। তাই হয়েছিল। উপরে তা লিখেছি। চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলের নির্যাতন কক্ষটির কথা বলতে হবে। ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে কুখ্যাত এই কক্ষে ইসলামী ছাত্রসংঘের একজন শীর্ষ নেতা ও বদর বাহিনীর কমান্ডার মীর কাশেম আলীর উপস্থিতিতে ও তার নির্দেশে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসীমের ওপর অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর নির্যাতন চলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে। মা এসেছিলেন বন্দী পুত্রকে বাঁচাতে। তাঁর ওপরও কঠিন চাপ ছিল মীর কাশেমের। জসীম যেন সব বলে দেয়। তা হলে মুক্তি। পুত্রের মৃত্যু হবে জেনেও মা তা বলেননি, বরং ওই জালেমদের অত্যাচার সহ্য করতে বলেছেন। মায়ের কথা রেখেছে জসীম। কতই বা বয়স তার, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসীম কোন তথ্য ফাঁস করেনি। শুধু মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের শেষ ইচ্ছা পূরণে মা এসেছিলেন ভাত নিয়ে। কিন্তু তার আগেই মীর কাশেমের সরাসরি নির্দেশে জসীমকে হত্যা করেছে ঘাতক বদর বাহিনী। পুত্রের মৃত্যুর পর ১৬ বছর বেঁচে ছিলেন মা, ভাত স্পর্শ করেননি। জসীম হত্যার ৪৫ বছর পর এই অপরাধের জন্য ১১ নম্বর অভিযোগে মীর কাশেম আলীর চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় হলো। রিভিউ রায় নিয়ে শঙ্কা ও সংশয়ের আরও একটি কারণ ছিল। আপীল শুনানিকালে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা প্রসিকিউশানকে এই মর্মে কঠোর সমালোচনা করেন যে, তারা সাক্ষীদের জেরা ও অভিযোগ প্রমাণে অযোগ্যতা দেখিয়েছেন। এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী ও সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেলের মনে শুধু নয়, জনমনেও আপীল রায় সম্পর্কে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে ৫ মার্চ, ২০১৬ তারিখে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় আপীল রায় নিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না বলে মন্ত্রিসভার দু’জন পূর্ণ মন্ত্রীর বক্তব্য প্রায় সকল টিভি চ্যানেল প্রচার করে। ডালপালা বিস্তৃত নানা গুজবের জন্মও দেয় তা। কী হতে যাচ্ছে? শেষ পর্যন্ত ৮ মার্চ তারিখে কাক্সিক্ষত আপীল রায় হয়েছিল সুপ্রীমকোর্টে। একই সঙ্গে মন্ত্রী দু’জনকে আদালতে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। মনে আছে পরদিন ‘মাথা সমুন্নত রেখেছে সুপ্রীমকোর্ট’ শিরোনামের প্রবন্ধটি লিখেছিলাম। এবারও রিভিউ শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সিনহা আবারও কঠিন তিরস্কার করলেন এ্যাটর্নি জেনারেলকে। প্রসিকিউশন আইনজীবীদের অযোগ্যতা নিয়ে কথা বললেন। বেশি অর্থ খরচ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যোগ্য আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দিলেন। নড়েচড়ে বসলেন অনেকে। আমার মনে অবশ্য কোন সংশয় ছিল না। কারণ একই যুক্তি যখন মীর কাশেম আলীর প্রধান আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন দিচ্ছিলেন, তখন প্রধান বিচারপতি এই মর্মে মত প্রকাশ করেছিলেন যে, অভিযোগ প্রমাণে সরকার পক্ষের নানা ত্রুটির পরও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কক্ষে আসামি মীর কাশেম নিজে হাজির ছিল এবং তারই নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা জসীমকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধাপরাধে সুপিরিয়র ও কমান্ড রেসপনসিবিলিটির কথাটি মনে রাখতে বলেন আইনজীবী মাহবুব হোসেনকে। ফৌজদারি দর্শন ও যুদ্ধাপরাধ মামলার দর্শন যে এক নয় তাও তুলে ধরেন। ‘ন্যাচারাল জাস্টিসের’ মর্মবাণীর কথা বললেন। এসব নিজে শুনেছি বলেই রিভিউ রায় নিয়ে শঙ্কাবোধ করিনি। তবে ২৮ আগস্ট শুনানি শেষে রায় না দিয়ে ৩০ আগস্টের জন্য রেখে দেয়ায় আবারও শঙ্কা দেখা দিল। খোদ এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম রায়ের ব্যাপারে নিজের উদ্বিগ্নতার কথা জানালেন। রায়ের একদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর এই সফরের সঙ্গে রায়ের কি কোন সম্পর্ক আছে? জনমনে সে প্রশ্ন ছিল। কেরির সফরের পরও জামায়াতের অন্যতম স্তম্ভ মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দণ্ড বহাল আছে। আমি এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। যেখানে জন কেরি ইতোপূর্বে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর না করতে বলেছিলেন, সেখানে তাঁর সফরের পর ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখায় এ কথা আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং রাগ-অনুরাগের উর্ধে উঠে ন্যায়বিচার করতে পারে। একই সঙ্গে বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে শক্তিধর আমেরিকাও বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলাতে দু’বার চিন্তা করবে। এখন মনে হয় ২৮ আগস্ট রায় হয়ে গেলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান এত স্পষ্ট হতো না। মীর কাশেম আলী জামায়াতে ইসলামের প্রধান অর্থ যোগানদাতা। সে কারণেই তাকে জামায়াতের অন্যতম স্তম্ভ বলেছি। ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে এই স্তম্ভ ধসে পড়বে। তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে ফাঁসি কার্যকর শুধু নয়, মীর কাশেমের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াফত করে তা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে না আনলে দেশে জঙ্গী তৎপরতায় অর্থের যোগানে জামায়াতের তেমন কোন সমস্যা হবে না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার প্রতি একটি বিনীত আবেদন রেখে এ লেখাটি শেষ করব। মহামান্য প্রধান বিচারপতি, বিচার কাজে বিশেষ করে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের আপীল ও রিভিউ মামলায় আপনি ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে ও ‘ন্যাচারাল জাস্টিসের’ মর্মবাণী ধারণ করে যে রায়গুলো দিয়েছেন তা বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা বিশ্বের বিচারিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাই আরও একটি ন্যায়বিচার সাধনের জন্য আপনার নিকট বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধুমাত্র শুরু হয়েছে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ-ের রায় এবং শত ষড়যন্ত্রের পরও তা কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশে একাত্তরের নির্যাতিত এবং এখনও ভীত-বিপন্ন মানুষ ক্রমে সাহসী হয়ে উঠছে। একাত্তরে যারা পাকিস্তানীদের দালাল হয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করেছে এবং এখনও প্রবল প্রতাপে সমাজে বিচরণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ও সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসছে সাধারণ মানুষ। তাই এই বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলবে। মানুষের ক্ষত নিরাময় হবে। দেশে সুশাসন কায়েম হবে। বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদবে না। সেসব বিবেচনায় নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের পক্ষ হয়ে ও ধর্ষিত মা-বোন যারা সকল যাতনা নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন তাঁদের পক্ষ হয়ে সনির্বন্ধ আবেদন করছি, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশটি আপনি প্রত্যাহার করে নিন। এই ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার কাজ চলতে থাকুক। ভবিষ্যতে এই ভবনটি হবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিদর্শক জাদুঘর। আপনি মহিমান্বিত হয়ে থাকবেন। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×