ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার বাদী

ইতিহাসের অংশ হয়ে চলে গেলেন মুহিতুল

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৬ আগস্ট ২০১৬

ইতিহাসের অংশ হয়ে চলে গেলেন মুহিতুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলে গেলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। ৬৩ বছর বয়সী মুহিতুল কিডনির সমস্যা নিয়ে গত মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ব্যক্তিগত সহকারীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শোক প্রকাশ করেছেন। মরহুমের ভাতিজা মাহবুবুল ইসলাম পিটুল সাংবাদিকদের জানান, আজ শুক্রবার সকাল দশটায় যশোরের ঝিকরাগাছায় তৃতীয় এবং জুমার নামাজের পর মনিরামপুরে গ্রামের বাড়িতে চতুর্থ জানাজা শেষে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের পর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে প্রথম এবং মাগরিবের নামাজের পর মিরপুর ১৪ নম্বরে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বলে পিটুল জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে আসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অনেকদিন ধরে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত মঙ্গলবার হঠাৎ তার অবস্থার আরও অবনতি হয়। সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে আসেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। বাদ আসর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মুহিতুল ইসলামের প্রথম জানাজার আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। হত্যার পর তিনি যখন মামলাটি করতে যান তখন তৎকালীন মোশতাক-জিয়া সরকার মামলা গ্রহণ করেনি। মামলা করার জন্য তিনি এ থানা থেকে ও থানা ঘুরে বেড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করলে তিনি মামলাটি করেন। ওই মামলার কারণে ইতিহাসের নৃশংস এ হত্যাকা-ের বিচার এবং তা কার্যকর দেশবাসী দেখতে পায়। তিনি আরও বলেন, দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। তার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করেছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দলের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু তিনি আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন, ফলে একটি ইতিহাসের সমাপ্তি হলো। উল্লেখ্য, কিডনির জটিলতা দেখা দেয়ায় গত ১১ জুলাই মুহিতুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ মুহাম্মদ রফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে গত ১০ আগস্ট তাকে আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে) রাখা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তার রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ ছিলেন মুহিতুল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সময় তিনি ধানম-ির ওই বাড়িতেই ছিলেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষা করতে জারি করেন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ১৯৭৯ সালে এ অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে বিএনপি সরকার অনুমোদন দিলে ১৪ আগস্ট ১৯৯৬-এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা বা এর বিচার নিয়ে কোন কথা হয়নি। ২ অক্টোবর ১৯৯৬ ধানম-ি থানায় এফআইআর দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী মুহিতুল ইসলাম। তবে সেটাই প্রথম নয়, এর আগেও চেষ্টা করেছিলেন মামলা করতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সব জায়গা থেকে যখন মুছে ফেলা হচ্ছে তার অবদান, ঠিক তখন অক্টোবর মাসে তিনি গিয়েছিলেন মামলা করতে, তবে ব্যর্থ হন। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করার পর থেকে পুলিশের পাহারায় থাকলেও ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তুলে নেয়া হয়েছিল। শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত যে দুঃসহ দিন কাটিয়েছেন, পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকেও সেই একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এ মানুষটিকে। বেশিরভাগ সময় আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ বাড়িতে অচেনা লোকজন খুঁজতে আসত। ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর বিচারিক আদালত ওই মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদ- দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল হলে হাইকোর্ট প্রথমে বিভক্ত রায় দিলে পরে তৃতীয় বেঞ্চে ১২ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখে। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্র্টে আপীল করে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে পাঁচ আসামির মৃত্যুদ- ইতোমধ্েয কার্যকর হয়েছে। তবে দ-িত বেশ কয়েকজন এখনও পলাতক রয়েছে। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এক শোকবাণীতে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারে মুহিতুল ইসলামের সাহসী ভূমিকা বাঙালী জাতি আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার সাহসী পদক্ষেপের কারণে দীর্ঘদিন পর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, খুনীরা শাস্তি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। শোকবাণীতে রাষ্ট্রপতি মুহিতুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারে সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার বার্তায় মুহিতুল ইসলামের সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করে বলেন, ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের সময় তিনি ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই ছিলেন। ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শিশু শেখ রাসেলকেও তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঘাতকরা নির্মমভাবে শেখ রাসেলকে হত্যা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মৃত্যুতে আমরা আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজনকে হারালাম। মুহিতুল ইসলামের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনাও জানান প্রধানমন্ত্রী। আইনমন্ত্রীর শোক ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এক বার্তায় এ শোক প্রকাশ করেন তিনি। আইনমন্ত্রী মুহিতুল ইসলামের বিদেহী আত্মার মাগফিরত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমাবেদনা জানান। সেতুমন্ত্রীর শোক ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি এক শোকবার্তায় মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। ঢাবি উপাচার্যের শোক ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এক শোকবার্তায় আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মুহিতুল ইসলাম জাতীয় ক্ষেত্রে এক দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে তার অবদান জাতি স্মরণ রাখবে। ড. আরেফিন বলেন, তিনি (মুহিতুল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আন্তরিকভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকা-। উপাচার্য মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানা। আইডিবির শোক ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মুহিতুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিবি)। আইডিইবির সভাপতি একেএম এ হামিদ ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ শামসুর রহমান এক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারে মুহিতুল ইসলামের সাহসী ভূমিকা জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রাখবে। তার সাহসী পদক্ষেপের কারণে দীর্র্ঘদিন পরেও জাতির পিতার ঘাতকরা শাস্তি পেয়েছে ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
×