ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ॥ চাকরি বহরে ৫ হাজার

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৬ আগস্ট ২০১৬

হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ॥ চাকরি বহরে ৫ হাজার

ঢাকা রিক্সার শহর এ কথা আমরা সবাই জানি। একবার পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত এক কবি ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে বহুল প্রচারিত এক কাগজে লিখলেন : ঢাকার রিক্সা, কলকাতার বাসের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে। রিক্সাওয়ালারাও গায়ে-গতরে শক্ত। কবির কথামতো ঢাকা শহরের সকল রিক্সাওয়ালাই গায়ে-গতরে শক্ত কী না, তা জানি না তবে এরা যে সংখ্যায় প্রচুর এবং ইদানীং ভাল রোজগার করে তাতে এখন আর সন্দেহ করা যায় না। রিক্সাওয়ালার সংখ্যা প্রচুর, তবে গত কয়েক দিনে তাদের সংখ্যা যে আরও স্ফীত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে, শত শত রিক্সা রাস্তায় ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মতিঝিল, গুলিস্তান, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, শান্তিনগর, মালিবাগ ও মৌচাকের মতো যে কোন চৌরাস্তায় একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে রিক্সায় রিক্সায় এলাকা সয়লাব। হঠাৎ করে কী রিক্সার সংখ্যা বেড়ে গেল? এর কারণ কী? একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে নতুন নতুন রিক্সাওয়ালা আসছে ঢাকায়, ঢাকা শহরে। পুরনো যারা তারা তো আছেই। নতুনরাও আসছে অবিরাম। এর কারণ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে দুটো। উত্তরবঙ্গের বন্যা একটা বড় কারণ। দ্বিতীয় কারণ কোরবানির ঈদ। ঈদের আগে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর নতুন রিক্সাওয়ালা আসে ‘ক্যাশের’ সন্ধানে, কাজের সন্ধানে। রোজার মাস ও ঈদ এবং পরের কোরবানির ঈদের সময় ঢাকায় কাজের পরিমাণ বাড়ে, শ্রমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। কিন্তু রিক্সা যারা ধরে তারা অন্য কাজ জানে না। রিক্সা চালনার কাজ তুলনামূলকভাবে সহজ। কোন প্রশিক্ষণ লাগে না। নতুনরা অভাবের তাড়নায়, রোজগারের আশায়, ‘ক্যাশের’ প্রয়োজনে তাদেরই গ্রামবাসী একজনকে অনুসরণ করে ঢাকায় আসে। এসেই রিক্সা ধরে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে এই রিক্সাওয়ালাদের বিপুল অংশ আসছে উত্তরবঙ্গ থেকে। একসময় ঢাকায় রিক্সাওয়ালা ছিল ফরিদপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর। সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন বাংলাদেশে ঐসব অঞ্চলের রিক্সাওয়ালাদের ‘আপগ্রেডেশন’ হয়েছে। তারা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকেছে। অনেকে বিদেশ যাত্রী হয়েছেন। উল্লিখিত বৃহত্তর তিন জেলার বহু লোক এখন প্রবাসী। ঐ খালি জায়গা এখন পূরণ করছে উত্তরবঙ্গের দরিদ্র অঞ্চলের লোকেরা এমনকি বৃহত্তর ময়মনসিংহের দরিদ্ররাও। ঐসব অঞ্চলে প্রবাসী বাঙালী খুবই কম, নেই বললেই চলে। শুধু দরিদ্র বলেই তারা আসছে তা নয়। ঢাকায় আসার সুযোগ করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। বলা যায় এই সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উত্তরবঙ্গে ও বৃহত্তর ময়মনসিংহে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য এনেছে। এখন হাজার হাজার রিক্সাওয়ালা ও শ্রমজীবী মানুষ ঢাকায় ও তার আশপাশ অঞ্চলে কাজ করে উত্তরাঞ্চলে ‘ক্যাশ’ পাঠায়। প্রবাসীদের তুলনায় ওদের ‘ক্যাশ’ কম। কিন্তু যেটুকু ‘ক্যাশ’ তারা রোজগার করে তাও কিন্তু কম নয়। একজন শক্ত-সমর্থ রিক্সাওয়ালা দিনে কমপক্ষে তিন-চার শ’ টাকা নিট রোজগার করতে পারে। মাসে হয় হাজার দশেক টাকা। মন্দ নয়। এই টাকা নিয়ে তারা দুই-তিন মাস পরপর নিজ বাড়িতে যায়। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়। কেউ কেউ জমি কিনে, বন্ধকী জমি ছুটায়, টিনের ঘর করে, ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি দেয়। চিকিৎসার খরচ যোগায়। বঙ্গবন্ধু সেতু এবং উত্তরবঙ্গীয়দের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে ওদের বেশ কিছুটা লাভ হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। তারা এখনও দারিদ্র্যের সঙ্গে, অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করছে। লড়াইটা বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক অঞ্চল থেকে তীব্রতর। অবশ্য উত্তরবঙ্গবাসীরা এই লড়াইয়ে একা নয়, তাদের সঙ্গে যোগ করা যায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক অঞ্চলের লোককে। যেমন নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকা, জামালপুর ও শেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকদের ভাগ্য ও বৃহত্তর রংপুরের লোকদের ভাগ্যের সমান। এই সব অঞ্চলে মাথাপিছু ব্যাংক আমানত ও ব্যাংকঋণ দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। উন্নয়ন কর্মীও এসব হতভাগ্য অঞ্চলগুলোতে কমÑ বড় বড় নেতাকর্মী, সরকারী কর্মকর্তা থাকার পরও। ফলে দেখা যায়, তারা দুই মুঠো ভাত হয়ত পায়, কিন্তু ভোগে অপুষ্টিতে। আর মুহূর্তের মধ্যেই তারা ছিটকে পড়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে। যেমন এবারের উত্তরবঙ্গীয় বন্যা। আগে বন্যা হলে বোঝা যেত। মানুষ সহানুভূতি দেখাত। এত টেলিভিশন, খবরের কাগজ ছিল না। যতটুকু খবর মিলত তাতেই মানুষ সহানুভূতি দেখাত। চাঁদা তুলত, শহরে গান গেয়ে মানুষকে গরিবের পক্ষে দাঁড়াতে বলত। এখন খবর বেশি, কিন্তু মানুষের সাড়া কম। সরকার সাহায্য দেয়। কিন্তু সেই সাহায্য বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘চাটার দল’ লুটেপুটে খায়। বন্যা মানেই তাদের জন্য মহোৎসব। রোজগারের সময়। কেউ ভাবেও না যে এই বন্যায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। হাজার হাজার ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কৃষকের গরু, ছাগল ভেসে গেছে, বাড়িতে রক্ষিত ধান-চাল জলে তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। ধান বাদে এখন অনেক ফসল। সেসব গেছে। বীজতলা নষ্ট হয়েছে। ডিপ-টিউবওয়েল নষ্ট হয়েছে। জলের কল নষ্ট হয়েছে। ঋণী কৃষক আরও ঋণী হবে। তার কিস্তি পরিশোধ সে করতে পারবে না। হাজার হাজার মানুষ খাদ্যবস্ত্র না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চিকিৎসার কোন সুব্যবস্থা নেই। এই যে দুঃখ ও দুর্দশা তা দেখে কী মানুষ এবার আলোড়িত হয়েছে? মনে হয় না। কিন্তু পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। অগণিত মানুষ বেশ কয়েক বছরের জন্য পেছনে পড়ে গেছে। সরকারের কাজ বেড়েছে। সরকারকে আবার নতুন করে এদের বাঁচানোর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। আর কী পরিকল্পনা হবে কে করবে পরিকল্পনা? কাগজে দেখলাম দুটো খবর। সরকারী বড় কর্মকর্তারা চান পরিকল্পনা কমিশনের বিলুপ্তি। ‘বোগাস’ একটি সংগঠন! কোন কাজ নেই। কাজ শুধু সবকিছুর বিলম্ব ঘটানো। পরিস্থিতিটা কতটুকু জটিল তা বোঝা যায় পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামাল সাহেবের ‘আহাজারি’ থেকে। তিনি আবেগের আশ্রয় নিয়েছেন, বলেছেন এই পরিকল্পনা কমিশন বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি। তিনি আরও বলেছেন রক্ত দিয়ে হলেও তিনি পরিকল্পনা কমিশনকে রক্ষা করবেন। প্রশ্নÑ পরিকল্পনা কমিশন না থাকলে কী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থাকবে? জানি না। বঙ্গবন্ধুর আমলে পরিকল্পনা কমিশন আমলাদের কমিশন ছিল না। শক্ত ও মর্যাদাবান কমিশন ছিল। বর্তমান সরকার একে তো আমলানির্ভর করেছে, যেমন করেছে ব্যাংকগুলোকেও। সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এখন শিক্ষক/গবেষকদের বদলে আমলারা। ‘এবাউট টার্ন’। এসবের কারণ বোঝা দায়। ব্যাংকের বোর্ডে এখন মারামারি/হাতাহাতি। অতএব প্রশ্ন তো এখন উঠবেই। প্রশ্ন এখন পরিকল্পনা কমিশন যদি না থাকে তাহলে উত্তরবঙ্গের লোকদের দুঃসময় থেকে বাঁচাবার পরিকল্পনা কে করবে? জেলা ‘শাসকরা’? উত্তরবঙ্গের প্রকৃত অবস্থা কী? তথ্যে দেখতে পাচ্ছি উত্তরবঙ্গের মানুষ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। চিলমারীর শিশুরা খর্বকায়। একটি কাগজের একটি রিপোর্টে দেখলাম চিলমারী অঞ্চলের পাঁচ বছরের কম বয়সী-শিশুর ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশই খর্বকায়। আবার ৪৯ শতাংশ শিশুর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জানা যাচ্ছে ঐ অঞ্চলে ক্রমাগত বন্যা, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদির ফলে সেখানে কৃষির উন্নতিতে স্থবিরতা এসেছে। কৃষি নেই, নদী নেই যেহেতু ছেলেরাও বেকার। নতুন পেশা নেই। মৎস্য সম্পদভিত্তিক কর্মকা-ও নেই। এই যে অবস্থা তা কী ১০০টি বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে সমাধান করা সম্ভব? কাগজে দেখলাম ‘মেঘনা গ্রুপের’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের খবর। নারায়ণগঞ্জের মেঘনার তীরে বেসরকারী উদ্যোগে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠবে। সরকার এর জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বলা হচ্ছে সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। চলতি বছরের শেষের দিকে ৬০০ কোটি ব্যয়ে মেঘনা পাল্প এ্যান্ড পেপার মিলস, ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা এডিবল অয়েলের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হবে। রয়েছে আরও বড় বড় অবকাঠামো ও কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। এই হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ শেষে চাকরির সংস্থান হবে কতজনের? বলা হয়েছে ৫ বছরে ৩০ হাজার লোকের চাকরি হবে। অথচ দেশে প্রতিবছর ২৫-৩০ লাখ লোক চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। তাহলে এই বিনিয়োগের কতটুকু উপকৃত হবে দেশের মানুষ? এসব প্রশ্ন ওঠে মনে। বড় বড় বিনিয়োগে কী চিলমারি এবং উত্তরবঙ্গের লোকের উপকার হবে? তাদের চাকরির সুযোগ কোথায় হবে? তাদের দারিদ্র্যসীমার উপরে ওঠার ব্যবস্থা কী হবে? তাদের অপুষ্টির সমস্যা দূরীকরণের ব্যবস্থা কী হবে? সারাদেশেই ভাত আছে, ভাতের অভাব নেই। কিন্তু শুধু ভাতে তো হবে না। মাছ দরকার, মাংস দরকার, সবজি দরকার, দুধ ও ফলমূল দরকার। দুই থেকে ছয় শ’ টাকা কেজি দরে যদি মাছ বিক্রি হয়, তাহলে সেই মাছ কে খাবে? লটকনের কেজি যদি ২০০ টাকা হয়, তাহলে সেই লটকন কে খাবে? এখন এসব ব্যাপারে ভাবতে হবে সরকারকে। শতহোক দেশে লোক ১৬-১৭ কোটি। তিলোত্তমা ঢাকায় বড়জোর থাকবে দুই কোটি। বাকি ১৪ কোটির কী হবে। এই প্রশ্নই তুলেছেন আকারে-ইঙ্গিতে বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×