ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাটর্নি জেনারেল আশা করেন আজই শুনানি শেষ হবে এবং দণ্ড বহাল থাকবে

নজর সুপ্রীমকোর্টে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ আগস্ট ২০১৬

নজর সুপ্রীমকোর্টে

বিকাশ দত্ত ॥ আজ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর রিভিউ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। মামলাটি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের কার্যতালিকায় ৫ নম্বরে রাখা হয়েছে। রিভিউ শুনানি সামনে রেখে দেশের জনগণের নজর আপীল বিভাগের দিকে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি থেকে শুরু করে আইনজীবী, প্রসিকিউটরগণের আশাবাদ, রিভিউ শুনানিতে সময় দেয়ার কোন কারণ নেই। কারণ এ মামলায় আগে অনেক সময় দেয়া হয়েছে এখন রিভিউটা শর্ট পার্ট। তারা আশা করছেন আজকেই রিভিউ শুনানি শেষ হতে পারে। পাশাপাশি আপীল বিভাগ যে মৃত্যুদ- প্রদান করেছিল তাও বহাল থাকবে। এদিকে আসামি পক্ষ তিন সপ্তাহের সময় চেয়ে দরখাস্ত করেছে। আজ এর উপর শুনানি হবে বলে তারা জানিয়েছেন। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুল হুদা জনকণ্ঠকে বলেছেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের মতো আমিও আপীল বিভাগের দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছি। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমি মনে করি রিভিউয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই সময় কম পেয়ে থাকেন। আমার দীর্ঘদিনের বিচার বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আজই রিভিউ শুনানি নিষ্পত্তি হতে পারে। এ মামলাটি যত দীর্ঘায়িত হবে ততই দেশে জঙ্গীগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমার জুনিয়র মীর কাশেমের ছেলে আহম্মেদ বিন কাশেম গুম হয়ে গেছে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, আশা করেছিলাম তিনি ফিরে আসবেন। এখনও আসেন নাই। মামলার সমস্ত কাগজপত্র তার কাছে। তার অনুপস্থিতিতে মামলা করার মতো তথ্য উপাত্ত কারও কাছে নেই। সে কারণে তিন সপ্তাহের সময় চেয়ে আবেদন করেছি। আজ এ আবেদনের উপর শুনানি করব। অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেছেন, মীর কাশেমের মামলার রিভিউ শুনানির জন্য আজ বুধবার দিন নির্ধারিত আছে। আমি আশা করি এক দিনেই শুনানি শেষ হওয়া উচিত। এর আগে মামলাগুলোও রিভিউ শুনানি একদিনের বেশি হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমি আশা করছি আপীলের দ- বহাল থাকবে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, সময় নেয়ার কোন কারণ নেই। রিভিউ শুনানিটা শর্ট পার্ট। আগে তারা অনেক সময় পেয়েছেন। মীর কাশেম আলী জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা। প্রথম দফায় তিনি ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করেন। এটা নরমাল কেস নয়। রিভিউয়ে বেশি শোনার কিছু নেই। নরমাল কেসে এত সময় দেয়া হয় না। গুরুত্বপূর্ণ এ সমস্ত কেসে এত বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। তবু আদালত দিয়েছে আমাদের তা মানতেই হবে। তারা আগে পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন। ন্যায় বিচারে স্বার্থে যা যা করার দরকার তা করা হয়েছে। সময় ক্ষেপনের কারণে জঙ্গী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আসামি পক্ষ কালক্ষেপণের জন্য সময় চাইতে পারে। সময় দেয়ার কোন কারণ নেই। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকে ভিতরে রেখে কালক্ষেপণ করা সঠিক বলে মনে করি না। তিনি আরও বলেন, এর আগে যে সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভউ শুনানি হয়েছে মীর কাশেমের মামলার বেলাতেও আশা করি তাই হবে। তিনি আরও বলেন, আশি আশা করি আপীল বিভাগ মীর কাশেমকে মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন, রিভিউতে তাই বহাল থাকবে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, আসামি পক্ষে সময় চেয়ে ফাজলামির কোন মানে হয় না। মামলাটি বিলম্বের কারণে দেশে হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। আমি আশা করব আপীল বিভাগ সমস্ত কিছু বিবেচনা করে আর কোন প্রকার সময় দেবেন না। দেশে যে সমস্ত সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটছে তা মীর কাশেমের টাকায়। লবিস্ট নিয়োগে মীর কাশেম ২৫ মিলিয়ন মাকিন ডলার দিয়েছে। বিলম্বের কারণে না হলে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ার মতো ঘটনা ঘটত না। মীর কাশেমের টাকায় জঙ্গীরা আরও উৎসাহিত হবে। যত দ্রুত সম্ভব মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। গোটা জাতি তাকিয়ে আছে। দেশে ৭০ ভাগ শহীদ পরিবার বেঁচে নেই। আর যারা বেঁচে আছে তারা এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চায়। আসামি প্েক্ষর আইনজীবী সময় চেয়ে প্রহসন করছে। আমরা কোনভাবেই তার শরিক হতে চাই না। মঙ্গলবার বিকেলে এ প্রকাশিত কার্যতালিকায় মীর কশেম আলী মামলাটি ৫ নম্বরে রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপীল বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মোহাম্মদ বজলুর রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে নেতৃত্ব দেবেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মীর কাশেম আলীর পক্ষে থাকবেন তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। উল্লেখ্য, মীর কাশেম আলীর মামলার তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২৬ জুলাই। তাকে গ্রেফতার করা হয় ২০১২ সালের ১৭ জুন। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন এর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণসহ ১৪টি অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু করে। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। ২০১৫ সালের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে মীর কাশেম আলী আপীল দায়ের করেন। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ আপীল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদ- বহাল রেখে আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় ৬ জুন প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাশেম। রিভিউ আবেদন শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি ২৫ জুলাই নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান এবং মামলাটি সোমবারের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ৬৩ নম্বর ক্রমিকে আসে। তবে শুনানির জন্য আরও সময়ের আবেদন করা হবে জানিয়ে মীর কাশেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম বলেছিলেন, “প্রস্তুতির জন্য দুই মাস সময়ের আবেদন করা হয়েছে। আপীল বিভাগের রায়ে এসেছে, এই মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ ত্রুটিপূর্ণ।” আদালত শুনানি পিছিয়ে দেয়ার পর আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, “প্রস্তুতির জন্য আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম। আদালত এক মাস দিয়েছে। ২৪ আগস্ট শুনানির তারিখ দিয়েছে।” রিভিউয়ের দিন ধার্য করতে ২১ জুন সকালে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনের দ্রুত শুনানির আর্জি জানানো হয়। ১৯ জুন মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- থেকে খালাস চেয়ে ১৪টি যুক্তি দেখিয়ে ৮৬ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন দাখিল করেন তার ছেলে আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাশেম। এর আগে গত ৬ জুন মীর কাশেমের ২৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পায়। ‘রিভিউ নিষ্পত্তি এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা’ নিয়ম অনুযায়ী এই দুটি আইনী প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর তার দ- কার্যকর করার উদ্যোগ নেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আইন অনুযায়ী রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার কথা মীর কাশেম আলীর। সে হিসেবে নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই ১৯ জুন তারা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেছেন। ৬ জুন দুপুরে রায় প্রকাশের পর সুপ্রীমকোর্ট থেকে রায়ের অনুলিপি বিচারিক আদালতে (ট্রাইব্যুনালে) পাঠানো হয়। পরে ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ট্রাইব্যুনাল থেকে মীর কাশেম আলীর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন বিচারকরা। লাল কাপড়ে মুড়িয়ে পরোয়ানাটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ, আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিসি অফিস তথা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। এর পরের দিন ৭ জুন সকালে কাশেমপুর কারাগার পাট-২ এ মীর কাশেম আলীকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়ে জানানো হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখে গত ৮ মার্চ মীর কাশেম আলীর আপীল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ। এর আগে ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই অভিযোগে মীর কাশেমের মৃত্যুদ- এবং আট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদ- হয়েছিল।
×