ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকায় ঘরবসতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২০ আগস্ট ২০১৬

নৌকায় ঘরবসতি

বংশ পরম্পরায় বেদেদের বাস নৌকায়। যাদের কোন ঘরবাড়ি নেই। নেই স্থায়ী ঠিকানা। যাযাবরের মতো। বছরে একেক সময় একেক জায়গায় নৌকা ভিড়ায়। নৌকায় তাদের ঘরবসতি। এক ঘাটে এরা বেশি দিন থাকে না। তিন মাস থেকে বছর দুয়েক অবস্থান করে ঘাট পাল্টায়। নিজেদের নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে তাদের বাস। ঘরগেরস্থালির এই নৌকা একটি বহরে একত্রিত থাকে। বহরে পনেরো থেকে ষাটটি নৌকা থাকে। প্রতিটি বহরে থাকে সর্দার। তিনি সঙ্গী নিয়ে বহরের নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক বিষয় দেখভাল করেন। বেদে পরিবারের জন্য থাকে একটি বড় নৌকা। নৌকার ধরন আলাদা। ছই ঘরের মতো। জানালা দরজা আছে। একধারে মাটির উনুন বসিয়ে রান্না করার জায়গা। স্বামী স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নৌকায় বসতি। ছেলেমেয়েরা বড় হলে বয়স বাড়লে তাদের আলাদা করে আরেক নৌকা বানানো হয়। এভাবে বাড়তে থাকে নৌকা পরিবার। বেদে পরিবারের যে রোজগার তা থেকে কিছু অংশ সঞ্চয় করে। জমানো সেই অর্থ দিয়ে নৌকা বানিয়ে দেয়া হয়। বেদেদের মধ্যে জাত আছে তিনটি। বৈদ্য, বৈরাল ও সান্দা। যারা সুশ্রী তাদের জাত বৈদ্য। এদের অন্যতম কাজ বাঁশের ঝাঁপিতে সাপ ভরে মাথায় নিয়ে খেলা দেখানো। সর্প দংশনের রোগীকে চিকিৎসা দেয়া। তাবিজ কবজ বিক্রি। এদের বৈদ্য কবিরাজ বলে। বৈদ্য জাতের নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। বিয়ের পর ঘরের বউ হওয়ার পর তারা নিজেদের রোজগারের পথ বেছে নেয়। এদের কথিত চিকিৎসার মধ্যে আছে দাঁতের পোকা তুলে দেয়া। বাতের ব্যথা বেদনা কমানো ও সাপে কাটলে গাছের ছালবাকর দেয়া। এরা কথিত এসব চিকিৎসা করে নগদ অর্থ ছাড়াও চাল ডাল পিঁয়াজ তেল লবণ তথা রান্নার উপকরণ নেয়। বৈরাল শ্রেণীর নারী ও পুরুষ বেদে সাধারণত জেলে। এরা বড়শি ও জাল দিয়ে মাছ ধরে তা বেচে জীবিকা চালায়। এরা রাত জেগে মাছ শিকার করে পরদিন তা বাজারে বিক্রি করে। এদের বড় বৈশিষ্ট্য হলো : দিনভর এরা নৌকায় থাকে। রাতে মাছ শিকারে বের হয়। কখনও কখনও এই শ্রেণীর নারী গ্রামে গিয়ে গান গেয়ে টোটকা চিকিৎসা করে। বৈরাল পুরুষ নৌকায় রান্নাবান্না থেকে সন্তান লালন পালন করে। শিশুর বুকের দুধ খাওয়ার সময় হলে মায়েদের কাছে দেয়া হয়। এদের শিশু বেড়ে ওঠে অনেকটা অযতেœ। সান্দা শ্রেণীর নারী বেদেরা চুড়ি ফিতা ক্লিপ ¯েœা পাউডার বিক্রি করে। এরা সাজতে বেশি পছন্দ করে। সাজগোজ করলেও এরা অন্যদের চেয়ে হিসেবি। গ্রামের চেয়ে শহরে ও গঞ্জে এদের যাতায়াত বেশি। এই শ্রেণীর পুরুষ বেদেদের প্রধান পেশা ছাতা মেরামত। হাটবাজারে গিয়ে এরা নির্দিষ্ট জায়গায় আসনে গেড়ে বসে। এই বেদেদের স্বামী-স্ত্রী দুজনই দিনমান বাইরে থাকে। রাতে নৌকায় ফিরে রান্নাবান্না করে। সান্দা বেদেরা উভয়ই ছোট ব্যবসার মধ্যে থাকায় অন্যদের চেয়ে সচ্ছল। বেদেরা সাধারণত মুসলিম ধর্মাবলম্বী। পরিচিত গ্রামে বেশি দিন থাকলে লোকজন তাদের আর ভাল চোখে দেখে না। বেশি গাওয়াল করতে পারে না। গাওয়াল হলো এরা যে কাজ করে তার নাম। আবার মাছ ধরার স্থান পরিবর্তন না হলে বেশি মাছ মেলে না। বেদের একেকটি বহর খেয়াল খুশিমতো নৌকা বেয়ে পছন্দের জায়গার নোঙর করে। এরা এতটাই সমাজবদ্ধ যে যদি পছন্দের কোন ঘাটে আগেই নোঙর করা কোন বহর দেখে তাহলে পুরনোরা স্বেচ্ছায় নোঙর তুলে নতুনদের জায়গা করে দেয়। বেদেরা শান্ত প্রকৃতির। তারা নদীর কোন শান্ত ও নিরাপদ স্থানে নোঙর করে। চেষ্টা করে নদীর কোন ধারে নোঙর করার। তবে সর্দার যেখানে নোঙর করতে বলে সেখানেই নৌকা ভিড়ায়। একটা সময় বেদেদের ডাঙ্গায় কোন ঘরবাড়ি ছিল না। পূর্বপুরুষ যেভাবে বসত করেছে তারাও সেই পথ ধরে বাস করে। তবে হালে তাদের বসবাসের পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই এখন জল ছেড়ে ডাঙ্গায় ঘরবসতি শুরু করেছে। অনেকে জমি কিনে ঘর বানিয়েছে। তবে ডাঙ্গায় বা শুকনো ভূমিতে এদের ঘরদোর কোন নদীর কাছাকাছি। অনেক বেদে খাস জমিতে প্রথমে বস্তির মতো ঘর করে বসবাস শুরু তরে। একসময় সেখানে ঘর তোলে। এভাবে অধিকাংশ বেদে নৌকা ছেড়ে শুকনা ভূমিতে বসতি গড়ছে। কাঠের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় এরা এখন নৌকা বানাতে হিমশিম খাচ্ছে। তা ছাড়া অনেক নদী এখন শুকিয়ে গেছে। নৌকা ভিড়িয়ে নদী তীরে থাকার দিনও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে এরা বেশি ভাবছে। একটা সময় সততার জন্য বেদেদের খ্যাতি ছিল। বেদে জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। নদীতে মাছ ধরতে গেলে তারা বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। বেদে বহরের সাবেক সর্দার কবিরাজ আলাউদ্দিন বলেন, যাযাবর শ্রেণীর বেদেরা দেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×