ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিমান্ডে আরও তথ্য পাওয়া গেছে তাহমিদ হাসিব খানের কাছ থেকে

মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ জঙ্গী ও সাত আত্মঘাতী শনাক্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৮ আগস্ট ২০১৬

মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ জঙ্গী ও সাত আত্মঘাতী শনাক্ত

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গত দুই বছর ধরে যে অর্ধশতাধিক জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা- সংগঠিত করেছে সেই জঙ্গী গ্রুপটিকে চিহ্নিত ও শনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা। এই জঙ্গী গ্রুপটির মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ জঙ্গীর নাম পেয়েছে তারা। যে ১৫ জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে আছেন মাস্টারমাইন্ড, অপারেশনাল কমান্ডার, কাউন্সিলর বা আধ্যাত্মিক গুরু ও সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ও হিযবুত তাহরীর সদস্যদের থেকে বাছাই করে তাদের নিউ জেএমবি বা নতুন জেএমবি গঠন করে মাঠে নামানো হয়েছে। মোস্ট ওয়ান্টেড এই ১৫ জঙ্গীর বেশিরভাগই সাংগঠনিক নাম (ছদ্মনাম) ব্যবহার করে জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা-ের জন্য যে ১৫ জঙ্গীকে খোঁজা হচ্ছে তার মধ্যে আছে ৪ জন মাস্টারমাইন্ড, ২ জন অপারেশনাল কমান্ডার, ২ জন জঙ্গী কাউন্সিলর (আধ্যাত্মিক গুরু) ও ৭ জন সুইসাইড স্কোয়াডের দুর্ধর্ষ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির জঙ্গীসহ মোট ১৫ জঙ্গীই হচ্ছে এখন মোস্ট ওয়ান্টেড। গুলশান, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা, কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় অভিযানসহ দেশব্যাপী দীর্ঘদিন ধরে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে মোস্ট ওয়ান্টেড এই ১৫ জঙ্গীই। দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক, শিক্ষক, পুলিশ, ধর্মযাজক, পুরোহিত, ভিন্নমতাবলম্বীদের মন্দির, মসজিদ, গির্জায় ওপর হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত করে আসছে তারাই। যেই ১৫ মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই জঙ্গী সংগঠনের সাংগঠনিক নাম। সিøপার সেল প্রক্রিয়ায় কাটআউট পদ্ধতিতে জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা- ঘটানোর পর যাতে কেউ গ্রেফতার হলেও দলের অন্যদের নাম ও পরিচয় খুঁজে বের না করতে পারে তার জন্যই সাংগঠনিক নাম ব্যবহার করছে জঙ্গীরা। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা এবং কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গীদের সম্পর্কে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, পলাতক যে ১৫ জঙ্গীকে খোঁজা হচ্ছে তার মধ্যে মোস্ট ওয়ান্টেড মাস্টারমাইন্ড ৪ জন হচ্ছেন নুরুল ইসলাম মারজান ওরফে সাগর ওরফে বাবু, সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও তামিম আহমেদ চৌধুরী। এতদিন ধরে মেজর জিয়া ও তামিম চৌধুরীর নাম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বলা হলেও গত সপ্তাহ থেকে নুরুল ইসলাম মারজান ওরফে সাগর ওরফে বাবুর নাম যুক্ত হয়। এখন আবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদীর নামটিও। প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশকদের হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিহিত করে তাকে গ্রেফতারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। জঙ্গীদের অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে নাম চলে এসেছে ২ জনের। তারা হচ্ছেন জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে আদিল ও রিপন। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় তারা দুইজনেই অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল দুইজনেরই। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলে যত মন্দির, গির্জায় হামলা হয়েছে এবং ধর্মযাজক, পুরোহিত, শিক্ষক, ভিন্নমতাবলম্বী হত্যা করা হয়েছে তারও অপারেশনাল কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছে দুইজনই। তাদের দুই জনকেই গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী যেসব জঙ্গীরা হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়েছে সেসব জঙ্গীদের কাউন্সিলিং করেছে বা আধ্যাত্মিক গুরুর দায়িত্বে আছেন মাওলানা আবুল কাশেম ও ডাক্তার নজরুল। তারা জঙ্গীদের বয়ান শোনাতেন এবং জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে শহীদী পথ বেছে নিতে উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতেন। জঙ্গীদের কাছে তারা আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই পরিচিত। এছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব জঙ্গীরা হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়েছে তাদের মধ্যে ৭ জন সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছে, মানিক, আজাদুল কবিরাজ, খালিদ, ইকবাল, বাদল, মামুন ও জোনায়েদ খানের নাম পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই সাত জনই সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য ছাড়াও আরও জঙ্গী সদস্য রয়েছে তাদের নাম পরিচয় উদঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেই ৭ জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে তারা খুবই ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, এসব জঙ্গীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান রয়েছে যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিষয়েও অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। তারাই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত করে ইসলামিক স্টেটস বা আইএস এর নাম ব্যবহার করে বার্তা পাঠিয়েছে। যেসব জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একেকজন অন্তত এক থেকে দুই ডজন পর্যন্ত হামলা ও হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় যে ৫ জন নিহত হয়েছে তার বাইরেও আরও সাত থেকে আট জন অংশ নিয়েছে এমনটই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বারই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অনুসারী এই সংগঠনটির সাংগঠনিক কোন কাঠামো নেই। গত দুই বছরে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক হামলা ও হত্যাকা-ের অংশ নিয়েছে এই জঙ্গী গ্রুপটি। এরাই নিউ জেএমবি বা নতুন জেএমবি হিসেবে পরিচিত। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি। যাদের মাস্টারমাইন্ড বা শীর্ষ নেতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরীকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খোঁজা হচ্ছে নব্য জেএমবির আধ্যাত্মিক দুই নেতা মাওলানা আবুল কাশেম ও ডাক্তার নজরুলকেও। ইতোমধ্যেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, জাহাঙ্গীর নামে এক দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির জঙ্গী যিনি সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য তিনি অন্তত ২২টি জঙ্গী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার সঙ্গেও জড়িত এই জাহাঙ্গীর। কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায়ও যাতায়াত ছিল তার। অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে তার নাম বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। তার নাম জাহাঙ্গীর হচ্ছে সাংগঠনিক নাম। একাধিক নাম রয়েছে তার। এর মধ্যে রাজীব ওরফে আদিল বা সুভাষ বা গান্ধী নামেও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চেনে তাকে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তত ২০ থেকে ২২টি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল সে। কোনটিতে নিজে সরাসরি অংশ নিয়েছে। কোনটিতে অর্থ বা অস্ত্রের জোগান দিয়ে সহায়তা করেছে সে। এই জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব ওরফে সুভাষ ওরফে গান্ধী ওরফে আদিল নামে এই তরুণ উত্তরাঞ্চলের অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতালম্বী, বিদেশী নাগরিক, উপাসনালয়গুলোয় হামলার সঙ্গে এই রাজীব জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে সে বিভিন্ন সিøপার সেলের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত হতো। এই জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলাসহ বিভিন্ন জঙ্গী হামলা, হত্যাকা- ও জঙ্গী কার্যক্রমের ওপর তদন্ত করার পাশাপাশি র‌্যাব, এসবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও ছায়া তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে। গুলশান, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা ও কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালনার পর যেই জঙ্গী গ্রুপটির সন্ধান পাওয়া গেছে, তা নতুনরূপে প্রকাশিত আরেক জঙ্গী গ্রুপ, যাতে রয়েছে উচ্চ শিক্ষিত ও বিত্তবান ঘরের সন্তানরা। এই জঙ্গী গ্রুপেরই মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে, যার মধ্যে আছে মাস্টারমাইন্ড, অপারেশনাল কমান্ডার, কাউন্সিলর বা আধ্যাত্মিক গুরু ও সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। এসব জঙ্গীদের গ্রেফতার করা গেলে জঙ্গী জগতের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা।
×