ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোন কোন যাওয়ার শূন্যতা থেকেই যায়

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১৭ আগস্ট ২০১৬

কোন কোন যাওয়ার শূন্যতা থেকেই যায়

যে উচ্চতায় ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ, সের্গেই আইজেনস্টাইন, জাঁ রেনোয়া, আকিরা কুরোশাওয়া বা সত্যজিৎ রায়ের নাম উচ্চারিত হয় চলচ্চিত্র জগতে তারেক মাসুদ নামটি সে উচ্চতা ছোঁয়নি, তবে নিজের কাজে জানান দিচ্ছিলেন ও পথেই হাঁটছেন তিনি। একদিন হয়ত বুক উঁচিয়ে আমরা বলতে পারতাম আমাদের সত্যজিৎ রায় আছেন আরও কাছের একজন তারেক মাসুদও আছেন। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসে ‘বার্থ অব এ নেশন’ তৈরি করে গ্রিফিথ আলোড়ন তুলেছিলেন। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র বানিয়ে এ দেশের দর্শক হৃদয় কাঁপিয়েছিলেন তারেক মাসুদ। তবু গ্রিফিথ আর তারেক এক নন। বিশাল ক্যানভাসের ‘বার্থ অব এ নেশন’-এ আমেরিকার কৃষ্ণদের প্রতি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করতে পারেননি গ্রিফিথ। তারেক পেরেছিলেন। তার দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধেই ছিল লড়াই। পরিচিত ঘটনাকে উল্টেপাল্টে ভিন্ন চোখে দেখতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে দর্শককে দুদ- ভাবতে বাধ্য করেছেন। এখানেই আলাদা তিনি অন্যদের থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ও রকম একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করা যায় এদেশে আগে কেউ ভেবেছিল? ভাবেনি মাদ্রাসা জীবন, অভিবাসী মনের দহন কিংবা ইসলামী জঙ্গীবাদকে বিষয়ের কেন্দ্রে নিয়ে ছবি বানানোর কথা। এই ভিন্ন চোখে দেখা এবং দেখতে শেখানোর দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরেছেন সারাদেশ। তবে তা মাস্টারের মতো নয় মোটেই, শৈল্পিক কিন্তু সরলভাবে। যে মুগ্ধতা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’ দেখে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘এর মধ্যে এমন কিছু নেই যা আমরা হাজারবার ভাবিনি, স্বপ্ন দেখিনি।... যা আমি কল্পনা করেছি, ভেবেছি, সেটাই রায় গুছিয়েগাছিয়ে খেটে করে ফেলেছেন।’ তারেক মাসুদও আমাদের ভাবনা ও দ্বন্দ্বের জায়গাগুলো কি করে যেন সাদামাটাভাবে গুছিয়ে বলে ফেলেছেন। আজকের এ অস্থির সময়ে তাকে বড় প্রয়োজন ছিল। এ দেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুরু গত শতকের ষাট দশকে। সেও ছিল এক ধর্মীয় উন্মাদনার কাল। তবে এখনকার মতো আগ্রাসী নয়। ‘জঙ্গীবাদ’ শব্দটির সঙ্গে সে সময়ে এ দেশের মানুষের তেমন পরিচয়ও হয়ত ছিল না। ওই উন্মদনার প্রায় পুরোটাই ছিল সাম্প্রদায়িক এবং তার বিরুদ্ধে শিল্পসাহিত্য অঙ্গনে তীব্র প্রতিবাদও ছিল। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ছিল, বলা যায়, তারই অংশ। মজার বিষয় হলো, সেই ষাট দশকে শুরু হয়ে সত্তর দশকের শেষ পর্যন্ত যে চলচ্চিত্র আন্দোলন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল আশির দশকে এসে তা ‘চলচ্চিত্র সংসদ রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮০’ নামে সরকারী নিয়ন্ত্রণ বিধির মুখোমুখি হয়। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র বিকাশের গলা টিপে ধরেছিল এ আইন। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। সচেতন তরুণরাই ছিল এর মূলশক্তি, সংগঠক ও দর্শক। তাই সব বাধা পেরিয়ে আন্দোলন এগিয়েছে। অনেক প্রতিভার ভিড়ে একজন তারেক মাসুদের জন্ম হয়েছে। পরিশীলিত দর্শক তৈরিতে চলচ্চিত্র সংসদগুলো অনন্য ভূমিকা রেখেছিল তখন। নব্বই দশক পর্যন্ত চাঙ্গা ছিল এসব সংগঠন। পৃথিবীখ্যাত ক্ল্যাসিক ছবি দেখার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছিল। সিনেমা দেখা, শো শেষে আড্ডা ও তর্কে কাপের পর কাপ চা ধ্বংস করে নতুন আইডিয়া নিয়ে ঘরে ফেরা- ভীষণ চলচ্চিত্রময় সে সময়ে একদিন গ্যেটে ইনস্টিটিউট দেখাল ‘আদম সুরত’- পনেরো মিনিটের তথ্য চিত্র। পরিচালক তারেক মাসুদ। তরুণদের মনে নামটি এক অন্যরকম ছাপ রাখল। কোথায় কিছু একটু যেন আলাদা এ সিনেমা। ক্যামেরা, এডিটিং সবকিছুতে আধুনিকতার ছোঁয়া। সাক্ষাতকারভিত্তিক ছোট একটি চলচ্চিত্র অথচ কি অসাধারণ প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা। আগামীর সম্ভাবনা প্রকাশ পেয়েছিল প্রথম কাজেই। তারেক চেয়েছিলেন এটি সরকারি প্রচার মাধ্যমেও দেখানো হোক। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তা পারেননি। বৈরী পরিবেশেই এগিয়েছেন। সবশেষ ‘রানওয়ে’ নিয়েও ঘুরেছেন সারাদেশ। প্রজেকশন করেছেন সাধারণ দর্শকের সামনে। তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’-এর তকমা এঁটে ড্রয়িং রুমবদ্ধ রাখতে চাননি নিজের সৃষ্টি। ‘মুক্তির গান’ নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাজ। কিন্তু তারেক মাসুদ শুধু এর মধ্যেই সীমিত নন। তাঁর বিশেষত্ব আধুনিক মনস্কতায়। শুধু কাজে নয়, ব্যক্তি জীবনেও। ব্যক্তি জীবন আর কর্মজীবন আলাদা ছিল না তাঁর কাছে। আমাদের দেশে ক’জন পুরুষ স্ত্রীকে কাজের সঙ্গী ভাবতে পারেন? ক্যাথরিন ছিলেন তার কাজের যোগ্য সঙ্গী। প্রতিটি ছবি দু’জনে মিলে করেছেন। সমসাময়িক সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন সব সময়। অহেতুক আঁতলামি প্রশ্রয় পায়নি। আবার স্রোতে গা ভাসিয়েও দেননি। তাঁর মাপের বা তাঁর চেয়ে বড় প্রতিভাধরদের অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তই হয়েছেন শুধু। দেশীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র ধরে রাখা ও তাকে এগিয়ে নেয়ার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন না। তারেক বাণিজ্যকে একটুও উপেক্ষা না করে দেশের অধিকাংশ মানুষের কণ্ঠস্বর ধরার চেষ্টা করেছেন। নিজস্ব সংস্কৃতির মূল স্রোতকে মেশাতে চেয়েছেন বিশ্ব প্রেক্ষাপটে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বড় মাপের কাজ করেছেন, কিন্তু এ নিয়ে ভাবালুতা ছিল না মোটেই। মতামত ছিল স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে এক লেখায় বলেছেন- ‘যুদ্ধ মানেই পক্ষ-বিপক্ষ। মুক্তিযুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই যুদ্ধ করেছেন, এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছি, এটাও ঠিক নয়। আমাদের নিজেদের সঙ্গে নিজেদের একটা যুদ্ধও ছিল। যুদ্ধটা আমরা করতে চাইনি। পাঞ্জাবি ঔপনিবেশিক শক্তি তা আমাদের ওপর চাপিয়েছিল। আমাদের একটি অংশ তাদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। ... স্থানীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হানাদার বাহিনী এবং তার দোসরদের গণহত্যার প্রধান শিকার ছিল একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী- এ ব্যাপারটিও আমাদের চলচ্চিত্র আখ্যানে সুস্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রধান অংশ হলো, মানুষ মানুষকে মেরেছে। কিন্তু এটাও পরম সত্য, একাত্তরে মানুষ মানুষকে বাঁচিয়েছে। একজন বিহারীকে বাঙালী বাঁচিয়েছে, একজন বাঙালীকে বিহারী বাঁচিয়েছে। একজন বাঙালী একজন নিরস্ত্র বন্দী পাকিস্তানী সৈন্যকে বাঁচিয়েছে। একজন পাকিস্তানী একজন বাঙালীকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই বহুমাত্রিক দিকটি কিন্তু সাধারণত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে প্রথম পর্যায়ে খুব একটা দেখি না।... আজকের বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে একাধিক আখ্যান থাকবে এবং পরস্পরবিরোধী বয়ান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক, মুক্তিযুদ্ধ মানেই যে ফর্মুলা, এভাবেই দেখতে হবে, অন্যভাবে বলার বা দেখার কোন অধিকার কোন শিল্পীর নেই, এটা ঠিক নয়।’ (কালের কণ্ঠ, ১৪ আগস্ট, ২০১১) তারেক মাসুদ হঠাৎ আবির্ভূত হননি। ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। কথা হয়েছে মাঝে মাঝে। ছোটখাটো নানা বিষয়ে মত চাইলে কিংবা চলচ্চিত্র বিষয়ে কোন জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন কোন ধরনের ভণিতা ছাড়াই। ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি এ করম হয়েছে কম। কখনও রিসিভ করতে না পারলে পরে ব্যাক করেছেন। ভরাট গলায় দৃঢ়স্বরে গুছিয়ে বলার ক্ষমতা ছিল তার। সম্ভবত নব্বই দশকের শুরুর দিকে গ্যেটে ইনস্টিটিউটে তানভীর মোকাম্মেলরা ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের আয়োজন করেছিলেন। বিদেশী বিভিন্ন ছবির নির্মাণশৈলী নিয়ে ক্লাস নিয়েছেন তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসিনরা। বিশেষজ্ঞ হিসেবে এসেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক চিদানন্দ দাশগুপ্ত। পশ্চিম বাংলায় তার মেয়ে অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড়। আমাদের এখানেও। চিদানন্দ দাশগুপ্তকে আমরা অনেকেই ঘিরে ধরেছিলাম- ‘বাবা হিসেবে নয়, সমালোচক হিসেবে বলুন...।’ বিরক্তি এড়িয়ে যথেষ্ট শান্তভাবে চলচ্চিত্রে শ্লীল-অশ্নীলের সীমারেখা বুঝিয়েছিলেন তিনি। আমাদের এখানে তখন আরেক ছবি জনপ্রিয়তার কারণ নিয়ে আলোচনার তুঙ্গে। নাম ‘বেদের মেয়ে জোছ্না’। নানাভাবে ডিসেকশন চলছে। এফডিসির বড় পর্দায় দেখাতে নেয়া হলো আমাদের (ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশগ্রহণকারী)। চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলবেন ওই সিনেমা নিয়ে। এফডিসির মূল গেট পেরিয়ে সামনে এগোতে চোখে পড়ে তারেক মাসুদ দাঁড়িয়ে। একটি পিলারে হেলান দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছেন। হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা। মুখে পরিচিত সেই স্নিগ্ধ হাসি। তার শারীরিক উচ্চতা প্রায়ই সত্যজিৎ রায়কে মনে পড়িয়ে দিত, একই জগতের মানুষ বলে হয়ত। কে না জানে সত্যজিৎ পথেঘাটে মানুষের মুখ পর্যবেক্ষণ করতেন। নিজের ছবির জন্য কোন মুখ পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে স্কেচ করে রাখতেন। তারপর তাকে খুঁজে বার করতেন। তারেক মাসুদও কি তেমন কিছু করছেন? তার দৃষ্টির প্রসারতায় সে সময় তেমনই মনে হয়েছিল। এ দেখা সাধারণ নয়। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কিছু খুঁজে নেয়ার দেখা। পাঁচ বছর আগের তের আগস্ট মানিকগঞ্জের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় তার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে কেন জানি না এফডিসিতে সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা বার বার মনে পড়ছিল। অত লম্বা চওড়া দৃঢ় মনের মানুষটি ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে পারেন না। কিছুতেই না। তিনি তো রাস্তা তৈরি করছিলেন। মনকে মুক্ত করার দৃষ্টিকে প্রসারিত করার রাস্তা। সে রাস্তায় অনেক দূর হাঁটার কথা ছিল। কথা রাখলেন না তারেক মাসুদ। শহীদ মিনারে কফিনে শুয়ে রইলেন। ক’দিনের টানা বৃষ্টির পর চড়চড়িয়ে রোদ উঠেছে। কিন্তু ভেতরে সবার বৃষ্টির ধারা। কফিন ঘিরে অজস্র্র ফুল। মনে হলো আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে কে যেন বলছে, এ ঠিক হলো না তারেক মাসুদ। লাইট, ক্যামেরা, এ্যাকশনের জায়গায় লাশ, কফিন, দাফন শব্দগুলো অনাহূত। এ শব্দগুলোয় আমরা বিদ্ধ হতে চাইনি। কোন প্রস্তুতি ছিল না। আমাদের বিশ্বাস হোঁচট খাচ্ছে এখনও। কফিন যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে...। টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড়- এখানকার আকাশে বাতাসে এখনও মিশে আছে শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কত তরুণ চলচ্চিত্র কর্মীর স্বপ্নের বুনন, কত উচ্ছ্বাস-পরিকল্পনা, কত ফিল্ম শো। জীবন ছুঁয়ে পৃথিবী দেখার উন্মাতাল আগ্রহ। পিচের রাস্তা খুঁজলে এখনও কি পাওয়া যাবে তারেক মাসুদের পায়ের ছাপ? ওই তো যাচ্ছেন তিনি- আদম সুরতের তারেক মাসুদ। মাটির ময়না, অন্তর্যাত্রা, রানওয়ের তারেক মাসুদ। চলেই গেলেন! তার চলে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ হয়নি এখনও। [email protected]
×