ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বলেছেন মনোবেদনার কথা ফেসবুকে

সইতেও পারি না রুখতেও পারি না- ॥ নীরবতা ভাঙলেন বাবুল আক্তার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ আগস্ট ২০১৬

সইতেও পারি না রুখতেও পারি না- ॥ নীরবতা ভাঙলেন বাবুল আক্তার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাবুল আক্তার। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর চৌকস এক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির গ-ি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন এসপি। নতুন এ পদে কাজ শুরু করার আগেই তার জীবনে ঘটে গেল মর্মন্তুদ এক ঘটনা। যে ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে গেছে তার স্ত্রী। স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে গত ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড় এলাকায় অত্যন্ত নৃশংস কায়দায় খুন করে ৭ সদস্যের একটি কিলিং মিশন। এ হত্যাকা- নিয়ে পুলিশ বাহিনীসহ দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে আছে। মামলা হয়েছে। তদন্ত চলেছে, এখনও চলছে। বহুভাবে এ তদন্ত করেছে একাধিক তদন্ত সংস্থা। তদন্তে হত্যাকা- ঘটানোর পুরো বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এ হত্যাকা-ের নেপথ্য নায়কের মুখোশ এখনও উন্মোচিত হলো না। শুধু তাই নয়, একজন এসপির স্ত্রী খুন হয়েছেন, এসপি নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলা এগিয়েছে বহুদূর। মূল কিলার ও তাদের সহযোগীরা একে একে গ্রেফতারও হয়েছে। দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। দুজন বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। দুজন কয়েকদফায় রিমান্ডে রয়েছে। কিলিং মিশনে নেতৃত্বদানকারী মুসা নামের এক সন্ত্রাসী যে বাবুল আক্তারের প্রধান ও বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে কাজ করত তার অবস্থান, পলাতক আছে না গুম করে ফেলা হয়েছে, না কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেও প্রাণ হারিয়েছে এর কোন কূল-কিনারা অদ্যাবধি হয়নি। এত গেল এসপি স্ত্রী হত্যাকা- ও পরবর্তীতে মামলা তদন্ত, গ্রেফতার, আসামির জবানবন্দী, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়াসহ যাবতীয় ঘটনার তথ্য। এর চেয়েও বেশি যে ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়ে আছে-তা হচ্ছে বাবুল আক্তারের পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসপি পদে চাকরির অবস্থান নিয়ে। পুলিশ সদর দফতর কিছুই বলছে না। বিভিন্নভাবে খবর বেরিয়েছে তিনি কাজে যোগদান করেছেন। অফিসে নিয়মিত যাচ্ছেন। শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছেন। কিন্তু পুলিশ সদর দফতর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ নিয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই। একজন এসপির স্ত্রী মর্মান্তিকভাবে খুন হওয়ার পর তিনি চাকরিতে আছেন কি নাই এ নিয়ে সরকারী কোন ব্যাখ্যা নেই। তাহলে স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটি সকলের মাঝে দোল খাচ্ছে এই বলে যে, স্ত্রী হত্যার নেপথ্য নায়ক কি স্বামী বাবুল আক্তার নিজে? যদি তাই হয় তাহলে আইন তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিনা? যদি না হয় তাহলে তার চাকরিগত ব্যাপার নিয়ে পুলিশ বিভাগ কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য আসছে না কেন। এ না আসার কারণে বাবুল আক্তারকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা গুজবের ডালপালা বিস্তৃতি লাভ করছে। অপরদিকে, যে বাবুল আক্তার কর্মক্ষেত্রে সফলতার ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতেন তিনি স্ত্রী হত্যাকা-ের পর মুখে রীতিমত কুলুপ এঁটে বসে আছেন। এও আরেক আশ্চর্যের বিষয়। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে তাকে কি বারণ করা হয়েছে, নাকি নিজেই মৌনতা অবলম্বন করে আছেন মনোবেদনার কারণে। এ অবস্থায় বাবুল আক্তার শনিবার নিজের ফেসবুকে প্রথমবারের মতো একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা দ্রুততম সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। উঠে এসেছে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে। বাবুল আক্তার ফেসবুকে যা লিখেছেন তা যে কোন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে । কিন্তু স্ট্যাটাসটি শুধু তার স্ত্রী মিতু ও তাদের সংসার জীবন এবং দুই সন্তানকে ঘিরে। পরোক্ষভাবে দোষারোপ করেছেন এই বলে যে, ঘটনা নিয়ে ‘নতুন নতুন গল্প বানানো’র অভিযোগ তুলে। দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙ্গে তার ফেসবুকের পাতায় লেখাটি নিম্নরূপÑ “এক সুন্দর দিনে সাধারণ এক কিশোরী বউ হয়ে আমার জীবনে এসেছিল। ঘর-সংসার কী অত বুঝত সে তখন? তাকে বুঝে উঠার সবটুকু সাধ্য হয়নি কখনও। কারণ সদাহাস্য চেহারা যার, তার অন্যান্য অনুভূতি ধরতে পারাটা কঠিন। তারপর যুগের শুরু। এক কিশোরীর নারী হয়ে উঠার সাক্ষী আমি। ছোট ছোট আবদার আর কথাগুলো ক্রমেই দিক পাল্টালো। হাতের নখের আকার পাল্টে গেল আমার খাবারটুকু স্বাস্থ্যকর রাখার জন্য। ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে মিশে গেল তার চব্বিশ ঘণ্টা, মাস, বছর এবং যুগ। রাতের পর রাত কাজ থেকে ফিরে দেখতাম, মেয়েটি ক্রমেই রূপ হারাচ্ছে রাত জেগে আমার অপেক্ষায় থেকে থেকে। হয়ত ভালবাসার চেয়ে স্নেহই ছিল বেশি। প্রথম সন্তানের জন্মের পর যেন সে স্নেহের ডালপালা ছড়াল। নিজেকে এত যতœ পাওয়ার যোগ্য আমার কখনই মনে হয়নি। পোশাক থেকে খাবার, কাজ থেকে ঘুম সবকিছুতেই মায়া। কাজের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা এই আমির সব পারিবারিক দায়িত্ব সে পালন করতে করতে সবার কাছে আমার নাম মানেই হয়ে উঠে তার অবয়ব। ততদিনে হয়ত সংসার বুঝে গিয়েছে সে। মেয়ে এল কোলজুড়ে। দেখতে অবিকল মায়ের মতো। সবকিছু জেঁকে ধরে কিশোরীটিকে নারী বানালো। কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে তার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসের সাক্ষী আমি। আমার সামান্যতম ক্ষতির আশঙ্কায় তার কেঁদে অস্থির হওয়ার সাক্ষী আমি। মেয়েটি কী আসলেই সংসার বুঝেছিল ততদিনে? কারণ আমি জানি আমি সংসার তখনও বুঝিনি। এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেল আমার, আমাদের জীবনে। নেহায়েত সাধারণ কিশোরীটি তখন নারী। ততদিনে সাধারণ মানুষটির ছোঁয়ায় আমার জীবন অসাধারণ। তখন সে সংসার বোঝে। কিন্তু আমি বুঝি না, এতেই কী এত ক্ষোভ ছিল তার? এতবেশী ক্ষোভ যে ছেড়েই চলে গেল? নির্ঝঞ্ঝাট সংসার হয়ত কোন দেবদূতেরও থাকে না। সে জায়গায় আমি তো সংসারই বুঝতাম না। কিন্তু সে সব বুঝত। আগলে ছিল আমাকে। সে চলে গেল, কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় রাখল না। সন্তান দুটো আমার বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতা। না হয় হয়ত পিছু নিয়ে জানতে চাইতাম, এভাবে যাওয়ার কারণটা। তারপর জীবনের শেষ মৃত্যুতে, না কী মৃত্যুতেই মুক্তি; এই বিশাল বাস্তবতা এসে চাপল আমার ঘাড়ে। শরীর থেকে মাথা কাটা পড়ার অনুভূতি কী এই জীবন মেনে নেয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর? যার সবটুকু শেষ হয়ে যায় তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার কিছু থাকে না। তবুও আমার কাছ থেকে আরও কী যেন চান স্রষ্টা ও সৃষ্টি! তারাই সব বলেন! গোলকধাঁধার মারপ্যাঁচ বোঝার বয়স কী হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী ছেলেটার? তার প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর দেয়ার মতো শব্দ দুষ্প্রাপ্য। যখন মা হারানো মেয়েটার অযথা গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার শব্দ কেবল আমিই শুনি, তখন অনেকেই নতুন নতুন গল্প বানাতে ব্যস্ত। আমি তো বর্ম পরে নেই, কিন্তু কোলে আছে মা হারা দুই শিশু। আঘাত সইতেও পারি না, রুখতেও পারি না। এরপর আর কোন ভোর আমার জীবনে সকাল নিয়ে আসেনি। সন্তান দুটো এবং আমি আর স্নেহের ছায়ায় ঘুমাইনি। এরপরই আমি বুঝেছি সংসার কী। সংসার মানে তুমি।”
×