ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বীরপ্রতীক গাজী রহমত উল্লাহ আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১২ আগস্ট ২০১৬

বীরপ্রতীক গাজী রহমত উল্লাহ আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. (অব) গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ দাদু (৭৯) বীরপ্রতীক আর নেই। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় তিনি খুলনা মহানগরীর শেখপাড়ার বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন। বৃহস্পতিবার বাদ জোহর নগরীর শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ মিনারের সামনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর নৌবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য দিয়ে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর পার্কে মরহুমের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার মরদেহ খুলনার পাইকগাছার গড়ইখালী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। শহীদ হাদিস পার্কে মুক্তিযোদ্ধা রহমত উল্লাহ দাদুর মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন ও জানাজায় অংশ নেনÑ নৌবাহিনীর কমোডর সামসুল আলম, সংসদ সদস্য এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা, আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান এমপি, মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা অঞ্চলের বিএলএফ বাহিনী প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ডেপুটি প্রধান শেখ ইউনুস আলী ইনু, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা শাখার সভাপতি মাহবুবর রহমান, নগর সংসদের সভাপতি অধ্যাপক আলমগীর কবির, বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা, উন্নয়ন আন্দোলনের নেতা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। গাজী রহমত উল্লাহ দাদু ১৯৩৭ সালের ১১ নবেম্বর পাইকগাছার গড়ইখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে প্রথম অবস্থায় বাংলাদেশের গণহত্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে যে ৮ বাঙালী সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেনÑ মুক্তিযোদ্ধা গাজী রহমত উল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্লাহসহ আরও ৭ বাঙালী নৌ-সদস্য ৫০০ যুবককে সঙ্গে নিয়ে নৌ-কমান্ডো দল গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৫ আগস্ট নৌ-কমান্ডোরা চিটাগাং, চালনা (মংলা), নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর এবং দাউদকান্দিতে প্রথম কমান্ডো অপারেশন পরিচালনা করেন, যা অপারেশন জ্যাকপট হিসেবে বিশেষ পরিচিত। এ অপারেশনে হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও রসদ বহনকারী ৩২ জাহাজ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, যা সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নৌ ও সমুদ্র পথে সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যুদ্ধের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, যা বাংলাদেশে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। তিনি গড়ইখালি, নীলকলম, চালনা, লক্ষীখোলা, পাইকগাছা, চাপড়া, আশাশুনি, শিয়ালডাঙ্গা, কপিলমুনি ও খুলনা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের প্রথম প্রভাতে স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা তিনিই প্রথম খুলনার সার্কিট হাউসের ওপরে উত্তোলন করেন। জাতির জনকের প্রত্যাবর্তনের দিন তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে নৌ-কন্টিনজেন্টের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ ইংল্যান্ডের মানাডন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত সমাজকর্মী এবং অতি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব (দাদু ভাই) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বরিশাল ও রাজশাহীসহ নৌবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে মসজিদ, স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশের টেক্সটাইল সেক্টরে যোগদান করেন। ১৯৮৭ সালে টেক্সটাইল মিল থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য তিনিই প্রথম দেশে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু করেন এবং দেশে বাগদার পোনার হ্যাচারি স্থাপন করেন। খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি চাষী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি খুলনা বিভাগীয় সেক্টর কমান্ডার ফোরামের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, গাজী রহমত উল্লাহ দাদু দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথরজনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়া ২০০০ সালে তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। তার গোটা পরিবারই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে পরিচিত। ১০ ভাইয়ের মধ্যে সাতজনই মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে একজন শহীদ, অন্যরা পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন।
×