ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাসনুভা তাবাসসুম

রহস্যময়ী মানবী বনলতা সেন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৫ আগস্ট ২০১৬

রহস্যময়ী মানবী বনলতা সেন

বাংলা সাহিত্যে আলোচিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বিশেষভাবে পরিচিত। বহু সাহিত্য প্রেমির হৃদয় ছোঁয়া এই কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ এই কবিতায় যে রহস্য তৈরি করেছেন সেই রহস্য এখনো ধোয়াশা। কেননা প্রতিটি কবিই তার প্রতিটি সৃষ্টিকে কাউকে না কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখেন। এই কবিতায় কবি কোন বনলতা সেনের কথা বলেছেন? বনলতা সেন নারী নাকি পুরুষ? এসকল প্রশ্নই মানুষের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কবি যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছেন সে কি নারী নাকি পুরুষ। কবিতায় কবি লিখেছেন- ‘অন্ধকার বিদিশার নিশার মত চুল’ ও ‘শ্রাবন্তীর কারুকার্যের মতো মুখ’ এবং ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ।’ বিদিশার দিশার মতো চুল নারী বা পুরুষ যে কারও থাকতে পারে। এখানে যদি দীঘল কেশ এর কথা বলা হতো তাহলে তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যেত নারীর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া যে মুখ ও চোখের কথা বলা হয়েছে সেটিও নারী বা পুরুষ যে কারও হতে পারে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যে কবিতায় নারী বা পুরুষের কোন পোশাকের কথা বলা হয়নি। এছাড়া কোনরকম প্রসাধনী/অলঙ্কার ব্যবহারের বর্ণনা নেই। বাঙালী নারী প্রসাধন-প্রিয়, বিশেষ করে সুন্দরী নারীরা এ ব্যাপারে আরও সচেতন। বনলতা সেন পুরুষ বলেই কি এসব কবির নজরে আসেনি? এরপরই যে প্রশ্নটি আসে সেটি হলো, কে এই বনলতা সেন? বনলতা সেন নামের কোন মেয়ের সঙ্গে কি জীবনানন্দ দাশের আদৌ পরিচয় ছিল? গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ উত্তরে কবি শুধুমাত্র একগাল মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। কবি কখনও নিজের অজান্তেও এই বিষয়ে কারও কাছে কিছু বলেননি। কবি নীরব থাকলেও যুগ যুগ ধরে গবেষকরা এই বনলতা সেনকে খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য। বাস্তবে এমন কোন বনলতা সেনের অস্তিত্ব তারা বের করতে পারেননি। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতায় মাত্র তিনবার ‘বনলতা সেন’ নামটি এসেছে। অথচ পুরো কবিতার অন্য আর কোন কিছু নিয়ে মানুষের কোন মাথা ব্যথা নেই। সবাই পড়ে আছেন শুধুমাত্র এই বনলতা সেনকে নিয়ে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা এখানে যে নারী নারী গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নাটোরে প্রচলিত একটি কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে একসময় ট্রেনে করে দার্জিলিং যেতে হলে নাটোরের উপর দিয়ে যেতে হতো। একদিন জীবনানন্দ দাশ ট্রেনে করে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি যখন নাটোর স্টেশনে পৌঁছায় তখন অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে ট্রেনে ওঠে। মেয়েটির সঙ্গে ভুবন সেন নামে একজন বৃদ্ধও ছিল। কবি যে কামরায় ছিলেন সেই কামরাতেই তারা উঠেন। কামরায় শুধুমাত্র এই তিনজনই ছিলেন। ভুবন সেন ছিলেন নাটোরের বনেদি সুকুল পরিবারের তারাপদ সুকুলের ম্যানেজার। অপরূপ সুন্দরী সেই মেয়েটি ছিল ভুবন সেনের বিধবা বোন ‘বনলতা সেন’। একসময় ভুবন সেন ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বনলতা সেনের সঙ্গে কবির আলাপচারিতা জমে ওঠে। এভাবে অনেকটা সময় তারা এভাবেই গল্প করে কাটিয়েছেন। এক সময় ‘বনলতা সেন’ ট্রেন থেকে নেমে যায়। কবি আবার একা হয়ে যান। ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি লাইন এখানে বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। তা হলোÑ ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’। গল্প-কাহিনী যত যাই থাক। কোনটিরই বাস্তবিক কোন ভিত্তি ও ইতিহাস সূত্র বহন করে না। জ্ঞানীগুণী গবেষকরাও বছরের পর বছর কাজ করে এই ‘বনলতা সেন’ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি। এটি আজও একটি অজানা রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।
×