ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমহান মহাশ্বেতা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৩১ জুলাই ২০১৬

সুমহান মহাশ্বেতা

মানুষ যখন নশ্বর তখন তাঁর শারীরিক প্রয়াণ আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না; ব্যক্তি যত পরমনির্ভর সদাকাক্সিক্ষত স্বজন হোন না কেন, তাঁকে বিদায় জানাতেই হয়। আজ যাঁকে চোখের জলে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছে বাঙালী সাহিত্যপাঠক এবং ভারতবাসী তাঁকে যে এইসব শোকার্ত মানুষ তাঁদের হৃদয়ে চির আসন দিয়ে রেখেছেন- এই সত্যটি শোকের ভেতর সামান্য সান্ত¡না হয়ে উঠছে মাত্র। মহাশ্বেতা দেবী তো কেবল একজন কালজয়ী কথাসাহিত্যিকই ছিলেন না, ছিলেন ভারতের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত দলিতজনের বড় সহায়, সহমর্মী বান্ধবÑ সেই কথাটি আজ পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন সচেতন মানুষ। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন বহির্বিশ্বে সর্বাধিক অনূদিত ভারতীয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম। সুমহান মহাশ্বেতার প্রস্থান তাই সত্যিকারার্থে এক অপূরণীয় ক্ষতি; এই ক্ষতি বড় বেদনার মতো বেজে চলেছে মানবপ্রেমী মানুষের মনে। মহাশ্বেতা দেবী বাংলাদেশের মেয়ে। ঢাকায় জন্ম ১৯২৬ সালে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকাতেই। দেশভাগের পর তাঁরা চলে যান কলকাতায়। কল্লোল যুগের খ্যাতিমান সাহিত্যিক মনীশ ঘটক ছিলেন তাঁর বাবা। মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন সাহিত্যিক ও সমাজসেবী। তাঁর কাকা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। আইপিটিএ ও গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য্যরে সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর পুত্রও একজন গুণী লেখক, নবারুণ ভট্টাচার্য্য। কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘জ্ঞানপীঠ’, ‘ম্যাগসেসে’, ‘বঙ্গবিভূষণ’, সাহিত্য ‘আকাদেমি’ পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অন্যান্য পাঠকপ্রিয় বই হলো- অরণ্যের অধিকার, নৈঋতে মেঘ, অগ্নিগর্ভ, গণেশ মহিমা, শালগিরার ডাকে, নীলছবি, বন্দোবস্তী, আইপিসি ৩৭৫, সাম্প্রতিক, প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে, মুখ, কৃষ্ণা দ্বাদশী, তিতুমীর ইত্যাদি। মহাশ্বেতা দেবীকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশের এক বর্র্ষীয়ান কথাসাহিত্যিক লিখেছেন : ‘যে মানুষ সমাজ থেকে বঞ্চিত, নিগৃহীত এবং বৈষম্যের শিকার তাদের পক্ষে লড়াইয়ে তার লেখনী ছিল চিরউদ্যত, তার কণ্ঠস্বর ছিল সোচ্চার। এই প্রতিবাদী অবস্থান তার সৃষ্ট শিল্প-সাহিত্যে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়।’ আমরা লেখক বলে নয়, শিল্পস্রষ্টা যে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সামাজিক অঙ্গীকারের কথা বলে থাকি। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা বহুসংখ্যক মানুষের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হোন। তাই তাঁদের লেখনী বা সৃষ্টি শিল্পের শর্ত পূরণের সমান্তরালে সামাজিক দায় পালন করছে কিনা তা নিয়ে সব সময়ই কথাবার্তা হয়ে থাকে। মহাশ্বেতা দেবীর একটি বা দুটি উপন্যাস যাঁরা পাঠ করেছেন তাঁরা ভালমতোই জেনেছেন এই লেখকের সমাজসজ্ঞান ভূমিকার বিষয়টি। হাজার চুরাশির মা, চোট্টি মু-া এবং তার তীরÑ মহাশ্বেতা দেবীর এ দুটি কালোত্তীর্ণ উপন্যাস লেখকের সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর লেখার টেবিল থেকে উঠে এসে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। লেখক হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেই বাকি নিরানব্বই ভাগ লেখকের মতো আত্মতুষ্টি লাভ করেননি। বরং সাহিত্যকর্ম থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে সরাসরি মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এমন উদাহরণ গোটা বিশ্বের লেখকসমাজে খুব বেশি নেই। এখানে তিনি অনন্যা। এই সুমহান লেখকের প্রতি আমাদের গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
×