ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

মানিটারি পলিসি ॥ ‘মানির’ ডিপোজিটরদের কী হবে?

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৯ জুলাই ২০১৬

মানিটারি পলিসি ॥ ‘মানির’ ডিপোজিটরদের কী হবে?

পহেলা জুলাই তারিখে নতুন অর্থবছর (২০১৬-১৭) শুরু হয়। তার আগে অর্থবিল পাস এবং বাজেট পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল নীতি) ঘোষিত হয়ে যায়, অবশ্যই এক বছরের জন্য। বাকি থাকে তিন গুরুত্বপূর্ণ নীতির মধ্যে বাণিজ্যনীতি (ট্রেড পলিসি) আর মুদ্রানীতি (মানিটারি পলিসি)। বাণিজ্যনীতি সময় মতোই ঘোষিত হয়। মঙ্গলবার ২৬ জুলাই যথারীতি ঘোষিত হয়েছে মুদ্রানীতি। বলাবাহুল্য, তিনটি নীতিরই উদ্দেশ্য সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়ন করা। এর মধ্যে বাজেটে ঘোষিত ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, দারিদ্র্য হ্রাস ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়। বর্তমান গবর্নর ফজলে কবীর যথারীতি তাই করেছেন। ঘটনাক্রমে এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি, যার মধ্যে আমরা পাচ্ছি ধারাবাহিকতা। বিদ্যমান বাস্তবতায় একটি উন্নয়নশীল দেশ যে ধরনের ‘মানিটারি পলিসি’ করে থাকে আমরা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য সেই নীতিই পেয়েছি। বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির টার্গেট হার হচ্ছে ৭ দশমিক ১ থেকে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারী খাতে ঋণ বাড়বে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী রেপো রেইট (যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ধার দেবে) হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং উল্টো ধার মানে রিভার্স রেপোর হার হবে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বলা হয়েছে মুদ্রানীতিটি বিনিয়োগবান্ধব এবং তা মূল্যস্ফীতিকে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখবে। কাগজে দেখলাম ব্যবসা ও শিল্পের নেতারা মুদ্রানীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হবেÑ এই খবরে উৎসাহিত ও খুশি। এদিকে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা সতর্কভাবে আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, এতে নতুনত্ব কিছু নেই। আগেই বলেছি, বিদ্যমান বাস্তবতায় এর চেয়ে ভাল মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা সুকঠিন একটি কাজ। গবর্নর তার নীতি ঘোষণার সময় বলেছেন ঋণ যাতে উৎপাদনশীল খাত এবং রফতানিমুখী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি খাত যাতে পর্যাপ্ত ঋণ পায় তার দিকে লক্ষ্য রাখা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের পর্যাপ্ততাও তিনি নিশ্চিত করবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, সুদের হার কমাতে হলে ‘নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল)’ কমাতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ বাংলাদেশে বেশি এ কথা উল্লেখ করে তিনি তা হ্রাসকল্পে ‘সুপারভিশন’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন বলে জানিয়েছেন। বিদ্যমান বাস্তবতায় যথাযথ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও যথাযথ অগ্রাধিকার স্থাপনের জন্য আমি ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং দক্ষ প্রশাসক গবর্নর ফজলে কবীরকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি তিনি ‘প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি’র কঠিন ব্যালেন্সিং-এ সফল হবেন। আমি আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতি এবং এক বছরের সার্বিক লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদির ওপর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এমন একটি প্রসঙ্গে যেতে চাই যার গুরুত্ব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমার চেয়ে বেশি সচেতন। মুদ্রানীতি যদি ‘মানিটারি পলিসি’ হয় তাহলে ‘মানিটারি পলিসি’ হচ্ছে ‘মানি’র কারবার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিভাষায় ‘মানি’ হচ্ছে ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংকস যোগ তলবি আমানত যোগ বিভিন্ন ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা’ (ন্যারো মানি)। এর সঙ্গে মেয়াদী আমানত যোগ করলে পাওয়া যায় ‘ব্রড মানি’। ‘ব্রড মানি’র সঙ্গে ‘পোস্ট অফিস ডিপোজিট’ যোগ করলে পাওয়া যাবে ‘মানিটারি এ্যাসেটস’। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ব্যবহৃত ‘মানির’ সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করছি একটা কারণে। আর সেটা বোঝানো যে, মানিটারি পলিসির পেটে আছে ‘আমানত’ (ডিপোজিট)। ‘ডিপোজিট’ দিয়েই ব্যাংকের শুরু, যা এক সময় সত্য ছিল না। এক সময় ব্যাংকিং শুরু হতো ‘ক্রেডিট’ দিয়ে। সেই পুরনো মতের সঙ্গে মানিটারি পলিসির বকলমে ঋণনীতিই আজকাল সামনে আসে। এতে অর্থনীতিবিদরা স্বস্তিবোধ করেন। কিন্তু যা ছাড়া ঋণনীতি হয় না সেই মানি বা ‘ডিপোজিট’-এর কী হবে? বিশেষ করে আজকের দিনে। ‘ডিপোজিটররা’ যদি না থাকে তাহলে মানি থাকে না। ‘মানি’ না থাকলে ‘ক্রেডিট’ (ঋণ) থাকে না, যদিও ‘ক্রেডিট ক্রিয়েটস ডিপোজিটস’। অতএব বড় প্রশ্ন ডিপোজিটরদের কী হবে? মূল্যস্ফীতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এখনও তা এর কাছাকাছিই। কিন্তু আমানতের ওপর সুদের হার কত? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের একটি প্রকাশনায় দেখতে পাচ্ছি সরকারী ব্যাংকের সঞ্চয়ী আমানতের ওপর সুদের হার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। বেসরকারী ব্যাংকে আরও কম। তিন মাসের মেয়াদী আমানতে বেসরকারী ব্যাংকে সুদের হার ৫ শতাংশের মতো। বলাবাহুল্য, বেশিরভাগ আমানতকারীর ‘টিআইএন’ নেই। অতএব সুদের ওপর ১৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কাটা হয়। যাদের ‘টিআইএন’ আছে তাদের করের হার ১০ শতাংশ, যা উৎসেই কেটে নেয়া হয়। এর অর্থ সুদের হার তিন-চার শতাংশে নেমে আসে। এর অর্থ মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় ব্যাংক সুদ দেয় কম। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখার অর্থ টাকার পরিমাণ হ্রাস পওয়া, লাভ তো দূরের কথা। এই সুবাদে ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার কমাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মহাখুশি। তারা সস্তায় ঋণ পাচ্ছেন। এটাই তাদের দাবি। তারা সস্তায় ঋণ চান; কিন্তু গৃহীত ঋণের টাকা ফেরত দিতে চান না। ঋণ পুনঃতফসিল করেন, ঋণের কাঠামো পরিবর্তন করেন, সুদ মাফ করান ইত্যাদি ইত্যাদি। ২৫-৩০ টাকার চিনি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করে যে লাভ হয় সেই অফুরন্ত লাভের টাকা দিয়েও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন না। উল্টো পিএডি (পেমেন্ট এগেনস্ট ডকুমেন্ট) ঋণকে লং টার্ম ঋণ করেন, সেই টাকা ব্যাংকের পর ব্যাংক কেনেন। তবু তারা কম সুদে ঋণ চান। কেউ লাভের টাকা ভাগে অনীহা এবং আইনী কাঠামোতে যেতে ভয়- ইত্যাদি কারণে শেয়ারবাজারে যেতে চান না, প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানি করতে চান না। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতেই মদদ দেয়। সরকারও প্রস্তুত ব্যাংক ঋণনির্ভর শিল্পায়ন নীতি কার্যকর রাখতে। এতে যে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ বাড়ছে, ঋণ শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে তাতে কারও খেয়াল নেই। নাও ঋণ, কর সুদ মাফ, না দাও মূল টাকা- তবু শিল্প কর। এই নীতির শিকার, নির্মম শিকার দেশের আমানতকারীরা-‘মানির’ মালিকরা। এদের চিন্তায় কেউ কথা বলে না। সবাই বলে ঋণের ওপর সুদ কমাও। এতে যে সঞ্চয়কারীরা শেষ হয়ে যাচ্ছে তার কথা কেউ ভাবছেই না। আমানতকারীরা তো হাঁস, ডিম পারা হাঁস। তাকে মেরে ফেললে কার লাভ? আমানত হচ্ছে লোকের সঞ্চয়, সঞ্চয়পত্রের টাকা সঞ্চয়কারীর সঞ্চয়। অদ্ভুত দেশ ঋণের কথা বলা হয়; কিন্তু কেউ সঞ্চয়ের কথা বলে না। দিন দিন যে ভুলনীতির কারণে সঞ্চয়ের হার স্থবির হয়ে পড়ছে তা বলার কেউ নেই। সরকারের, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কত উপদেষ্টা, কত পরামর্শক। সবাই ‘আইএমএফের’ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। আমানতকারীরা ‘মানির’ মালিকরা যদি পর্যাপ্ত সুদ না পায়, তাদের আয় যদি দিন দিন হ্রাস পায়, বিপরীতে খরচের বোঝা বাড়ে, করের বোঝা বাড়ে তাহলে বিনিয়োগ দিয়ে কী হবে? বিনিয়োগ মানে উৎপাদন বৃদ্ধি। উৎপাদিত মাল কে খাবে? যদি মধ্যবিত্তের আয় হ্রাস পায়, সঞ্চয়কারীর আয় হ্রাস পায় তাহলে জামা-কাপড়, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি কে কিনবে? এগুলো রফতানি হবে? বাইরের লোক খাবে? খাক, তারাই খাক। দেশের মানুষ উপোস থাকুক। এটা কোন নীতি হতে পারে না। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবীরকে অনুরোধ করব বিষয়টি নিয়ে ভাবতে। ঋণের ওপর সুদের হার কমাতে গিয়ে যদি আমানতকারীরা ঠকে, তাদের পেটে আঘাত করা হয় তাহলে টেকসই উন্নয়ন কী সম্ভব হবে? দরকার আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতার স্বার্থের সামঞ্জস্যপূর্ণ মিলন। উভয়ের স্বার্থ দেখা প্রয়োজন। ‘মানিটারি পলিসির’ ভিত্তিমূলে ‘মানির’ মালিকরা আছেন তাদের দিকে দৃষ্টি দিন। শিল্পপতিদের সুনাম অর্জন করে শেয়ারবাজারে যেতে বলুন, লাভ ভাগাভাগি করতে বলুন। ইতোমধ্যেই ব্যাংক ঋণনির্ভর শিল্পায়নের ‘কস্ট’ মাত্রার বাইরে চলে গেছে। খেলাপী ঋণ, ‘রিটেন অফ লোনের’ পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। একথা গবর্নরও বলেছেন। এই ঋণের টাকা যদি গরির কৃষকরা পেত, যদি এই মওকুফ করা ঋণের টাকা দশ লাখ, বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ টাকার ঋণ গ্রহীতারা পেত তাহলে দুশ্চিন্তা কম করতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে সিঙ্গাপুরে সম্পদ কেনা হচ্ছে, ইথিওপিয়ায় ফ্যাক্টরি করা হচ্ছে, ভিয়েতনামে পোশাক কারখানা করা যাচ্ছে। এটা সহ্য করা যায় না। ‘মানির’ মালিকদের দিনের পর দিন ঠকিয়ে এই কা- চলতে পারে না। মূল্যস্ফীতির বোঝা, করের বোঝা, খেলাপী ঋণের বোঝা, সুদ মওকুফের বোঝা, শিল্পায়নের বোঝার সবটাই ‘মানির’ মালিকরা (ডিপোজিটর) বহন করবে এটা কোন বিচার হতে পারে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×