ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামের চর-দ্বীপচর ভাসছে পানির ওপর

নৌকার শব্দ পেলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসে মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৬

নৌকার শব্দ পেলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসে মানুষ

রাজু মোস্তাফিজ, নাগেশ^রীর দুর্গম চর ঘুরে এসে ॥ কুড়িগ্রামের নাগেশ^রীর উপজেলার ভিতরবন্দ আর নুনখাওয়ার দুর্গম চর-দ্বীপচরের বন্যাকবলিত মানুষগুলো নৌকার শব্দ শুনলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসছে। তারা এ মুহূর্তে শুকনা খাবার চায়। ব্রক্ষপুত্র, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদীর পারে দুটি ইউনিয়নের ১৮ মৌজা এখন পুরোপুরি পানির নিচে। তাদের ঘরের মধ্যেই কোথাও এক মাথা কোথাও এক বুক সমান পানি। উঠোনে ও ভেলা অথবা ডিঙ্গি নৌকায় চলাফেরা করতে হয়। এতদিন অনেকেই ঘরের মাচানের ওপর আশ্রয় নিয়েছিল, অনেক বাড়িতে সেখানেও পানি উঠেছে। বাধ্য হয়ে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ^বর্তী বিভিন্ন স্কুলে, মাদ্রাসায় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে,ওয়াবদা বাঁধে অথবা দুরের কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানেই নিয়ে উঠেছে তাদের গরু ছাগল হাঁস মুরগি। সেখানে গাদাগাদি করে কোন রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ মুহূর্তে প্রতিদিন যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে রান্না করে খাবার মতো অবস্থা আর নেই। চারদিকে পানি আর পানি। পানিতে থাকতে থাকতে তাদের একমাত্র সম্বল গরু ছাগলগুলো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চরম খাদ্যের কষ্টে পড়েছে গরু ছাগলগুলো। আর এ সব গৃহপালিত পশু খাদ্যের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গরু ছাগল মারাও গেছে। বন্যার পানির তীব্র স্র্রোতে কয়েক হাজার হাঁস মুরগি মারা গেছে। টানা ৯দিন ধরে পানিতে থাকতে থাকতে বন্যাকবলিত এসব মানুষও খাদ্যাভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র গঙ্গাধর নদ-নদীর চর-দ্বীপ চরের যে গ্রামেই গেছি সেখানেই মানুষের কাছে অভিযোগ শুনেছি তারা কোন ত্রাণ পাননি। আসলেই অধিকাংশ মানুষ কোন ত্রাণ পায়নি এই দুর্গত জনপদে। সরকারী পর্যায়ে দু’ দফায় খুব সামান্য পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করেছিল। তাও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। এখনও কোন বেসরকারী সংস্থা, স্থানীয় সুশীল সমাজ অথবা কোন এনজিও বন্যাদুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ায়নি। একটু খাবারের জন্য অভুক্ত মানুষের যে কি আকুতি চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। বুধবার সকালে ভিতরবন্দ ও নুনখাওয়া ইউনিয়নের দুধকুমার, গঙ্গাধর, আর ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম চর-দ্বীপচরের শান্তিপুর, গুড্ডামারী, ওয়াবদাগড়, ভাটিগাঁও, ঝাকুয়াবাড়ি, গোডডারপার, মরনেয়ারপার, দিকদিয়ারী, মরাডিকডারী, হাতিবান্ধা, খেনপাড়া, বারাবানারভিটা, কোচপাড়া, বানিয়াটারী, ম-লেরহাট, প-িতপাড়া, ভিতরকুটি, নওদাপাড়া, ব্যাপারীরচর, চরকাপনা, কালীকাপুর, পাটতোলা, পঞ্চনারপার, সাহেবগঞ্জ, সারিসুরি, বোয়ালমারী এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেছি মানুষের দুর্ভোগ। ভিতরবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাচ্চু খন্দকার জানান, তার ইউনিয়ন পুরেটাই এখন পানির মধ্যে ভাসছে শুধু ভিতরবন্দ বাজারের জায়গা টুকু ছাড়া। ভিতরবন্দ মহিলা কলেজ, ভিতরবন্দ ফাজিল মাদ্রাসা, নন্দনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকনিরপার প্রথমিক বিদ্যালয়, এবং ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদে বন্যাকবলিত দুই হাজার মানুষ ৪দিন আগে উঠেছে। তাদের সাথে তাদের গরু, ছাগল আর হাস মুরগিও রয়েছে। তিনি আরও জানান, অর্ধাহারে অনাহারে এ মানুষগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে থাকতে কাহিল হয়ে পড়ছে। কোন অপরিচিত মানুষ এ সব আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে অভুক্ত মানুষ একটুখানি খাবার চায় কিন্তু কে দিবে তাদের খাবার। আমি যখন দুপুরে ভিতরবন্দ মহিলা কলেজে যাই এখানে শান্তিপুর এলাকার ধনেন্দো বেওয়া (৭০) স্বামী মৃত খবিরুল, চার সন্তান তার। সন্তানদের সাথে উঠেছেন। একপ্রকার উপোস দিন কাটাচ্ছেন। সন্তানরা যখন খাবার দেয় তখন খান তিনি। এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ পায়নি তারা। এখানে আসা আয়েশা (৩৭) স্বামী আমজাদ, শরীফা স্বামী হাতেলসহ কয়েক শ’ মানুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে উঠেছে এই আশ্রয় কেন্দ্রে। এরা গ্রামে মাটি কাটার কাজ করে। এখন কাজ বন্ধ চরম কষ্টে এই আশ্রয় কেন্দ্রে জীবন কাটাচ্ছে। নুনখাওয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজালাল উদ্দিন জানান, তার এলাকায় শুধু বাজার ছাড়া আর সব জায়গায় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তার ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার আর গঙ্গার নদের মোহনা। বর্তমানে নৌকা ছাড়া কোন যাতায়াতের সুযোগ নেই। সব গ্রামীণ কাঁচা পাকা সড়ক এখন পানির নিচে। একটি মৌজা থেকে অপর মৌজা যেতে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ২০হাজারেরও বেশি। দু’ দফায় ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৯ মে.টন জি আর এর চাল আর ৫ হাজার টাকা। এগুলো মাত্র ১ হাজার বানভাসী মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। ১০টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার মানুষ উঠেছে। কি যে কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে এ সব মানুষ চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যাবে না। তিনি আরও জানান, আমার কাছে সারাদিনেই মানুষ আসে খাবারের জন্য। অনেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে খাবারের আকুতি জানায়। বোয়ালমারী গ্রামের মহেশ (৫৫), সাবান আলী (৫৬), শ্রী ধরন জনান, মাছ বিক্রি করে সংসার চালাই কিন্তু বন্যার পানিতে নদীতে মাছ পাওয়া যাওয়া যাচ্ছে না তাই বেকার দিন কাটাচ্ছি। আমাদের ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। এখন সন্তানদের নিয়ে দিনরাত মিলে একবার করে খাচ্ছি। কোন সরকারী ত্রাণ পাইনি। ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রশীদুর জানান, ত্রাণ এত কম আমাদের ৯ ওয়ার্ডে এক মে.টন করে এখনও চাল দিতে পারিনি। প্রতিদিন তার ৫০ থেকে ১শ’ মানুষ খাবারের জন্য আসে, কিন্তু আমি নিরূপায়। নাগেশ^রীর ইউএনও আবু হায়াৎ মোঃ রহমত উল্লা জানান, নাগেশ^রী উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ১০ ইউনিয়ন পুরোপুরি এবং ২ আংশিক বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। স্কুলসহ ৩০ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০ মে.টন চাল আর তিন লাখ ৮৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তিনি জানান, মধ্যে এবারের বন্যা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তিনি জানান, দুর্গত সময়ে বন্যাকবলিত দুস্থ মানুষদের তিন মাসের খাদ্য সাপোর্ট দেয়া জরুরী। কারণ এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তাদের। কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক বুধবার নিজ উদ্যোগে নুনখাওয়া, ভিতরবন্দ এবং যাত্রাপুরের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ৭ শতাধিক বন্যার্ত মানুষের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
×