ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

এই সন্ত্রাসের প্রাণভোমরা দেশের মাটিতেই লুকিয়ে আছে

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৭ জুলাই ২০১৬

এই সন্ত্রাসের প্রাণভোমরা দেশের মাটিতেই লুকিয়ে আছে

সন্ত্রাস নিয়ে লিখতে লিখতে নিজেকেও একজন সন্ত্রাসী মনে হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’ আমার মনে হয়, ‘সন্ত্রাস স্পন্দিত বুকে আমিই সন্ত্রাসী।’ একদা বিশ্বতারুণ্যের চোখে ছিলো বিশ্ব বিপ্লবের স্বপ্ন। এখন তা দখল করেছে বিশ্ব সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসী সমাজের বাইরে আমারও অবস্থান নয়। সুতরাং আমিও কি একজন সন্ত্রাসী নই? কর্মে, না হয় বাক্যে ও আচরণে সন্ত্রাস এখন কোথায় নেই? সারা বিশ্বে যে অসহিষ্ণুতা ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে, তা থেকেই বর্তমান সন্ত্রাসের জন্ম। তা থেকে মুক্তিলাভের উপায় কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না। না, প্রেসিডেন্ট ওবামা, না আমার মতো একজন নগণ্য সাংবাদিকও। মঙ্গলবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানলাম, ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশ ও জঙ্গীদের যুদ্ধে নয়জন জঙ্গী নিহত হয়েছে। জঙ্গী নিহত হচ্ছে সর্বত্রই। ফ্রান্সে, জার্মানিতে সাম্প্রতিক হামলায় সন্ত্রাসীও বাঁচতে পারেনি। সন্ত্রাসী মরছে, কিন্তু সন্ত্রাস মারা যাচ্ছে না। এক সন্ত্রাসীর মৃত্যুর পর যেন দশ সন্ত্রাসীর জন্ম হচ্ছে। আমাদের রূপকথায় আছে, এক রাক্ষস মারা গেলে তার রক্তে এক শ’ রাক্ষসের জন্ম হয়। তাই রাক্ষস বধের অভিযানে বের হওয়া রাজপুত্রকে এক ব্যাঙমা-দম্পতি উপদেশ দিয়েছিলো আগে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে ঝিনুকের মধ্যে লুক্কায়িত রাক্ষসদের প্রাণভোমরা ধ্বংস করো, তাহলে সকল রাক্ষস মারা যাবে। রাজপুত্র তাই করেছিলেন। এখন প্রশ্ন, রূপকথার রাক্ষসদের চাইতেও ভয়াবহ এই সন্ত্রাসীদের প্রাণভোমরা কোথায় লুকিয়ে আছে? তাদের প্রাণভোমরা কি একটি? রামায়ণের রাবণের মতো তারা দশানন নন। বিভিন্ন দেশে তারা বিভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হচ্ছে। কোথাও তারা আইএস, কোথাও তারা তালেবান, কোথাও আল কায়েদা, কোথাও জামায়াত, জেএমবি অথবা হিযবুত। এরা বিভিন্ন দেশে একই উদ্দেশ্যে হয় বিচ্ছিন্নভাবে লড়ছে, নয় তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। আমেরিকা এই সত্যটাকেই উপেক্ষা করেছে এবং বলছে, এটা কেবল আইএসের সন্ত্রাস, আসলে এ যুগের সন্ত্রাসী দানবের প্রাণভোমরা একটি নয়। বাংলাদেশে এ যাবত যত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার অধিকাংশের সঙ্গেই জেএমবি এবং আনসারুল্লাহ- এই দুই জঙ্গী গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই দুই জঙ্গী গ্রুপেরই জন্ম বাংলাদেশের জামায়াত নামক ধর্মীয় রাজনৈতিক দল থেকে। এই জামায়াত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এবং গণহত্যায় শরিক দল হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা তাকে ‘মডারেট ইসলামী দল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার কাজে সাহায্য যুগিয়েছে। বিএনপি এই দেশদ্রোহী এবং স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করে দেশের সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনে শিক্ষা ব্যবস্থায়, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। এই অবস্থান থেকে তাদের হটানো রাতারাতি সম্ভব নয়। তাই এখন দেখা যাচ্ছে উচ্চবিত্ত পরিবার এবং আধুনিক শিক্ষার ইউনিভার্সিটি থেকেও সন্ত্রাসী তরুণ বের হচ্ছে। এদের সন্ত্রাসে প্রলুব্ধ করার কাজে বিদেশ থেকে দেদার টাকা আসছে। এই সন্ত্রাস শুধু দমন করা নয়, উচ্ছেদের জন্য শেখ হাসিনা সরকার সাহসের সঙ্গে লড়ছেন। এই লড়াই সফল করতে হলে দেশে জাতীয় ঐক্য দরকার। দেশে সেই ঐক্য গড়েও উঠেছে। দলমতনির্বিশেষে দেশের মানুষ এখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। বিএনপি এই ঐক্য শক্তিশালী করতে চান, না এই ঐক্যে ভাঙন ধরাতে চান, তাও এখন এক প্রশ্ন। মনে হয়েছিল, দেশে সন্ত্রাসের মূল আসামি জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়ে এবং নিঃশর্তভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নামবে। তা হয়নি। বিএনপির এক নেতা সম্প্রতি বলেছেন, তার দলনেত্রী ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেই উদ্যোগে জামায়াতকে বাদ রাখা হবে না। কারণ জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল এবং সরকার এখনও তাকে নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করেনি। আসলে বিএনপি নেতার এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। সরকার জামায়াতকে একটি যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেন। এখনও এই জামায়াতকে কেন নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়নি সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। জামায়াত যে বাংলাদেশে সকল সন্ত্রাসের উৎস এটা সর্বজনবিদিত। সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরাও তাদের নেত্রীর কাছে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আবেদন জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, জাতির কাছে জামায়াতের প্রবীণ নেতারা যে অপরাধ করেছেন, সেজন্য দলটির নতুন নেতাদের ক্ষমা চাইতে হবে। এক কথায় জামায়াত যে একটি সন্ত্রাসী দল তা সকলেই এখন স্বীকার করছেন। এই অবস্থায় সরকার এই দলকে বেআইনী ঘোষণা করেনি এই অজুহাতে তাকে বিএনপির সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্যজোটে ডাকা কি খোঁড়া যুক্তি নয়? আসল কথা, বেগম খালেদা জিয়া এখন চালিত হচ্ছেন তার লন্ডনে পলাতক পুত্র তারেক রহমানের দ্বারা। এই দুর্বৃত্ত জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে রাজি নন। অন্যদিকে এই সেদিন জামায়াতের পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসে বিএনপি সহযোগী ছিল। জামায়াতকে ঘাঁটাতে গেলে তার অনেক কেচ্ছাকাহিনী ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সুতরাং বিএনপি এখন উভয় সঙ্কটে। জামায়াতের সংশ্রব সম্পূর্ণ ত্যাগ তরা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দলটি তার শরীর থেকে সন্ত্রাসের গন্ধ দূর করার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু অপ্রকাশ্য সম্পর্কটি থেকেই যাবে। সন্ত্রাস দমনে সন্ত্রাসীদের নিয়ে ঐক্য গড়ার এই ডাক হবে একটি প্রহসন। বাংলাদেশে সম্প্রতি যে সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়েছে, তার একটি মূল কারণ, সামনে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মীর কাশেমের মামলার রিভিউর রায় দেয়ার তারিখ রয়েছে। এই তারিখটি মহামান্য আদালত পিছিয়ে দিয়েছেন। এই রায় দেয়ার তারিখ পিছিয়ে দেয়ার পেছনে মহামান্য আদালতের হয়ত কোন সুবিবেচনা রয়েছে, কিন্তু এর সুযোগ গ্রহণ করছে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক সন্ত্রাসীরা। তারা সন্ত্রাসের তৎপরতা বাড়িয়ে এই রায় প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাতে তারা সফল হবে না। কিন্তু দেশের কিছু নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এই ঘটনা আগেও ঘটেছে। যখনই সা. কা. চৌধুরী বা মতিউর রহমান নিজামীর মতো যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষিত হয়েছে তখনই দেশে সন্ত্রাস চালিয়ে, নিরীহ মানুষ হত্যা করে এই দ-াদেশ বানচাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার ধারণা, অবশিষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য আর ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত এই বিচার পর্বের সমাপ্তি ঘটানো উচিত। তাতেই দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হবে না, কিন্তু আপাতত বহু নিরীহ মানুষের প্রাণরক্ষা পাবে। আমেরিকা বলছে আইএস। কিন্তু আমার ধারণা, বাংলাদেশের সন্ত্রাসের পেছনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানই বড় কারণ। এই সন্ত্রাসের মূলনায়ক জামায়াত এবং তার উপদলগুলো। মধ্যপ্রাচ্যে গাল্ফ যুদ্ধ থেকে যে বিশ্ব সন্ত্রাসের উদ্ভব, তার প্রভাব বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের শক্তিশালী করেছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের জন্য অর্থ ও অস্ত্রের যোগান আসছে বাইরে থেকেই। মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে যদি সন্ত্রাস পরাজিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সন্ত্রাসও নিরুৎসাহিত ও শক্তিহীন হবে। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই সন্ত্রাসের আসল নায়কদের সন্ধান এবং তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করার আগ্রহ পশ্চিমা শক্তির ছিলো না। তারা ভেবেছিলো, মধ্যপ্রাচ্যেই এই ধ্বংসলীলা সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এখন তার আসল প্রভুকে খুঁজে পেয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় এই সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। বারবার ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ইউরোপের টনক নড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ এমনকি বিগ মিডিয়ায় পর্যন্ত দাবি উঠেছে, এই বিশ্ব সন্ত্রাসকে উচ্ছেদ করার জন্য অবিলম্বে একটি ইন্টারন্যাশনাল সামিট বা আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন ডাকা হোক। তাতে রাশিয়া এবং সিরিয়ার আসাদকেও ডাকা হোক। আসাদবিরোধী তৎপরতায় সাহায্যদান বন্ধ করা হোক। এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাকে আইএসের দখলমুক্ত করা হোক। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সাম্প্রতিক বৈঠককে পশ্চিমা মিডিয়ায় অভিনন্দন জানানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে।’ ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলা সম্প্রসারিত হওয়ায় কবিবাক্য সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। সন্ত্রাস নিয়ে খেলা যে আগুন নিয়ে খেলা এখন এটা ইউরোপের মানুষ বুঝতে পেরেছে। যতোদিন মধ্যপ্রাচ্যে এই আগুন জ্বলেছে, ততোদিন ইউরোপ-আমেরিকার বহু মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে। মনে করেছে এটা ভিডিও গেম। এখন সেই ভ্রম তাদের দূর হয়েছে। ফলে শাসকদের উপর চাপ বাড়ছে, পলিটিক্যাল গেম বন্ধ করে এই সন্ত্রাস থামাও। মনে হয় এই গণদাবির মুখে আমেরিকাকে তার নীতি পাল্টাতে হবে। আইসেনহাওয়ার যেমন প্রেসিডেন্ট হয়ে কোরিয়া যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে বাহবা কুড়িয়েছিলেন, বর্তমানে হিলারি বা ট্রাম্প যিনিই হোয়াইট হাউসে বসুন, এই বিশ্ব-সন্ত্রাস দমনে একটা পদক্ষেপ নিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাইবেন। যদি তারা বর্তমান নীতি আকড়ে থাকেন, তাহলে এই সন্ত্রাসের আরও বিস্তার ঘটবে। বাংলাদেশের হাসিনা সরকার বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা সন্ত্রাস যেমন প্রতিহত করেছে, তেমনি বর্তমানের সন্ত্রাসও দমন করতে পারবে বলে আমার ধারণা। এই সন্ত্রাসের প্রাণভোমরা দেশের মাটিতেই লুকিয়ে আছে। তাকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করার কাজে সরকার নেতার ঐক্য নয়, জনগণের ঐক্য গড়ে তুলুন। সন্দেহ নেই কল্যাণপুরের ঘটনা জনগণের মনে সাহস ও শক্তি জোগাবে। সন্ত্রাস দমনের কাজে তাদের মনে উৎসাহ জোগাবে। [লন্ডন, ২৬ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১৬ ॥]
×