ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২১ জুলাই ২০১৬

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের শিক্ষা

দেশ রক্ষা যাদের কাজ, দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রহরা দান কর্তব্য যাদের, তারাই যদি হয়ে বসেন দ-মু-ের হর্তাকর্তা এবং তাও জোরপূর্বক অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে, তাহলে বিপত্তি যেমন বাড়ে, তেমনি মানুষের অধিকার হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। জংলি আইনের বিস্তার, স্বাভাবিক বিধি-বিধান, আচার-আচরণ, কানুন মুখথুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়। অধিকারহীন হয়ে পড়ে মানুষ। মানবতার সব দরজা-জানালা সিলগালা হয়ে যায়। আর বন্ধ ঘরে মাথা কুটে মরতে হয় অমানবিকতার রোষে। সভ্যতা ভব্যতার লেশমাত্র আর থাকে না। বন্যতা সর্বত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুঃশাসনের নিগড়ে বাধা পড়ে দেশ ও জাতি। গণমুখী আইন-কানুন তখন শিকেয় চড়ে ঝুলে থাকে নিষ্ফল আর্তনাদকে সঙ্গী করে। দেশে-দেশে কালে-কালে এমন দৃশ্যপট মানবজাতিকে অবলোকন যেমন করতে হয়েছে, তেমনি ভুগতে হয়েছে তারই যাঁতাকলে। রক্ষক যদি হয়ে ওঠে ভক্ষক, তখন বিপদ নামে, অন্ধকারের করাল গ্রাস থাবা দেয় সবখানে। তাতে ক্ষতবিক্ষত হয় দেশ ও জনগণ। সে এক কাল ছিল বিশ শতকে, যখন উর্দিপরা অস্ত্রধারীরা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল করে নিয়ে জংলি শাসন চালু করত। বেতার-টিভিতে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের কল্পিত কাহিনী ছড়াত। কুৎসা রটানো হতো। আর নিজেদের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে জনসমর্থন পাবার জন্য নানা ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিত। তারপর শুরু হতো বশংবদ তৈরির চেষ্টা। এমনকি জান্তারা রাজনৈতিক দল গঠন করে উর্দির বাইরে এসে দেশে-বিদেশে নিজেদের গণতন্ত্রের উদ্গাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট হতো। খড়কুটোটিও নড়ত না তাদের হুকুম ছাড়া। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য হত্যাযজ্ঞ, গুম, ইত্যাকার মন্দ দিকগুলোকেও বেছে নেয়া হতো। দশকের পর দশক শাসন ক্ষমতা নিরংকুশ রাখার জন্য কেড়ে নেয়া হতো বাকস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষ সেই তিক্ত অভিজ্ঞতায় জারিত। পাকিস্তান এখনও উর্দি নিয়ন্ত্রিত দেশ। প্রতিবেশী মিয়ানমার দীর্ঘ জান্তাশাসিত থাকার পর এখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ শাসন করে যাচ্ছে। সর্বশেষ তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের অবসান হলেও বিস্ময় থেকেই গেছে। যে দ্রুত প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেকে পুনর্বহাল করলেন এবং তুর্কী জনগণ যেভাবে ট্যাঙ্ক ও কামান বন্দুকের সামনে প্রতিরোধ দাঁড় করাল, তা গণতন্ত্রের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। নির্বাচিত শাসক নিকৃষ্টমানের হলেও জংলি শাসন থেকে তা উৎকৃষ্ট বৈকি। যা প্রমাণ করেছে পুরনো ধারা ও পদ্ধতিতে সামরিক অভ্যুত্থান অচল আজ বিশ্বজুড়ে। অস্ত্র উঁচিয়ে ক্ষমতা দখল করে শাসন চালানোর দিন ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী দুই জান্তা শাসক স্বাধীনতার মূল্যবোধকে খর্ব, সংবিধানকে তছনছ, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের প্রসার, দুর্নীতিসহ নানাবিধ অপকর্মকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জেনারেল জিয়ার সময় ডজনেরও বেশি গোপন অভ্যুত্থান হলেও তা দমন করা হয়েছে গোপনে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার আইন জারি করেছে। যারা এ কাজ করবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশেও গত জাতীয় নির্বাচনের সময় সেনা ছাউনিতে গড়ে ওঠা দলের কোন কোন নেতা সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়েছিল অভ্যুত্থান করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের সেনাবাহিনীর ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে সারাবিশ্বই একটা শিক্ষা পেয়েছে মন্তব্য করে বলেছেনও, বাংলাদেশে যারা উস্কানি দিত, তারাও একটি শিক্ষা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে কেউ আর এ ধরনের ‘ক্যু’ করার সাহস পাবে না। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি ও বিস্তারের যুগে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ যে সহজ সাধ্য নয়, তুরস্ক সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কোন দেশের জনগণই চায় না জান্তা শাসন। তারপরও এখনও বহু দেশে জান্তা শাসকরা রয়েছে গণতন্ত্রের লেবাস ধারণ করে। বাংলাদেশের জনগণও তাই বর্তমান নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কোন অপতৎপরতা মেনে নেবে না। জনগণই এদেশে এখন সকল ক্ষমতার উৎস।
×