ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

জঙ্গী দানবে পিষ্ট ফরাসীরা

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১৮ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী দানবে পিষ্ট ফরাসীরা

বিপন্ন বিশ্বে মানুষ আজ হয়ে পড়েছে একাকী যেন। মানব সভ্যতা রীতিমতো হুমকির মুখে। মানবতা বর্তমানে সন্ত্রাস কবলিত। এর শেষ কোথায়, কিংবা পরিণতি কী, সেটা ভাবলেও শিউরে ওঠে মনপ্রাণ। বিশ্বের কোথাও বুঝি আজ আর মানুষ নিরাপদ নয়। সমগ্র মানবতা ও সর্বজনীন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ। মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মানবদেহ খুনীদের মধ্যে উল্লম্ফন জাগাচ্ছে। হত্যার দৃশ্যসমূহ ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিশ্ব বুঝি আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের প্রায় মুখোমুখি। নিরীহ, অসহায় নাগরিক বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন। যা বিশ্বমানবকে ক্রমশ ক্ষুব্ধ করে তুলছে। আফগানিস্তানে একদা সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য সরাসরি মার্কিন মদদে ইসলামকে সামনে নিয়ে যে মুজাহিদীন বাহিনীর সূত্রপাত, সেই বিষবৃক্ষ কালক্রমে তালেবান, আল কায়েদা, আল শাবাব, বোকোহারাম, নুসরা ফ্রন্ট ইত্যাদি নানা নামে ডালপালা ছড়িয়ে চূড়ান্ত পরিণামে রূপ নেয় আইএস নামের ভয়ঙ্কর এক দানবে। কল্পিত জিহাদের নামে এরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গী নেটওয়ার্ক ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম। ২০০১-এর নিউইয়র্কে হামলার কাজটি মার্কিনীদের সৃষ্ট তালেবান, আল কায়েদা সম্পন্ন করার পর, তাদেরই সৃষ্ট এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে ছিল যুক্তরাজ্য। কিন্তু ফ্রান্স সেই সময়ে এই দুই শক্তির জোটের পাশে দাঁড়ায়নি সেভাবে। এমনকি ইরাক অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফ্রান্সের তীব্র মতপার্থক্যও ঘটেছিল। তারপর পেরিয়ে গেছে পনেরো বছর। ইরাকে রক্ত নদী বইয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জোটের সেনারা ফিরে গেছে। আফগানিস্তানেও সেনাবাহিনীর আকার হ্রাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই তিন দেশে মার্কিন নীতি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। আজকের আইএস তাদের ‘কুনীতির’ ফসল বলে মতপ্রকাশ করা হয় নানামহল থেকে। দুঃখজনক হলো, জঙ্গীবাদের এই ফ্রাঙ্কেন্টাইনস সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রের। জঙ্গীদের সবচেয়ে বড়পরিচয় আজ তারা ধর্মবিরোধী, মানবতাবিরোধী খুনীচক্র। তাদের হামলা ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব মানবের সমর্থন ব্যাপকার্থে পায়নি। এদের কর্মকা- সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ সচেতন হচ্ছে। দেশে দেশে সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই এদের প্রতি। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সতত সোচ্চার থাকলেও হঠাৎ হঠাৎ চোরাগোপ্তা জঙ্গী আক্রমণে বিপদাপন্ন হয়ে উঠছে অনেক দেশের মানবজীবন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এমনকি খোদ আমেরিকাতেও জঙ্গীদের জঙ্গীপনার বিস্তার ঘটেছে। অবশ্য জঙ্গী হানা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি সজাগ ও সতর্ক। তুলনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফ্রান্স, বেলজিয়াম নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শৈথিল্যই প্রদর্শন করছে। এই দুটি দেশ যেন জঙ্গী জিহাদীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও জঙ্গীরা আস্তানা গেড়ে বসেছে। ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়াতে এরা সক্রিয়। বাংলাদেশেও জঙ্গীদের তৎপরতা একুশ শতকের শুরুতেই বিস্তার লাভ করেছে রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট হয়ে। ফ্রান্স সরাসরি আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও বাংলাদেশের এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। বরং বাংলাদেশের জঙ্গীরা রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় প্রবাসীদের মদদপুষ্ট হয়ে উঠছেÑ এমন তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ঘটনায় বিশ্ববাসী শোকাহত থাকা অবস্থায় আবারও আক্রান্ত হয়েছে ফ্রান্স। গত বছরের নবেম্বরে প্যারিসে একসঙ্গে ছয়টি স্থানে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার আট মাস পর দেশটির নিস শহরে হতাহতের ঘটনা ঘটল। ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের পতনের বার্ষিকীতে প্রতি ১৪ জুলাই জাতীয় দিবস পালন করে দেশটি। নবেম্বরের হামলার পর দেশটিতে তিন দফায় জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। সে কারণে ফ্রান্সের দিবস ও বড় বড় জমায়েতগুলোতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু নিসের ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল ছিল বলেই হামলাকারী আঘাত হানার সুযোগ পেয়েছে। সাড়ে তিন লাখ অধিবাসীর উপকূলীয় শহর নিস পর্যটন ও জাঁকজমকপূর্ণ রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি এ শহরের বেশ কয়েকজন মুসলিম অধিবাসী ইউরোপের অন্য দেশ হয়ে সিরিয়া গেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। তারা জঙ্গীগোষ্ঠী আইএসে যোগ দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ফ্রান্সে ফিরে এসে হামলা চালানোর আশঙ্কা তাই প্রতি পদে পদে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ১৪ জুলাইয়ের হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা উল্লেখ করে বলেছেন, ফ্রান্স এখন ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকির মুখে। এর বিরুদ্ধে লড়তে সম্ভব সবকিছুই করতে হবে ফ্রান্সবাসীকে। ইউটিউবে দেয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, চারদিকে উচ্চলয়ের বাজনা আর উৎসবের আমেজের মধ্যে সাদা রঙের ২৫ টন ওজনের ভারি ট্রাকটি আশি কিলোমিটার গতিতে এসে উৎসবে জড়ো মানুষের ওপরে উঠে পড়ে। মানুষ পিষ্ট হয়ে মরেছে ট্রাকের চাকায়। চালকও মাঝে মধ্যে পুলিশের গুলির পাল্টা গুলি ছুড়েছে। পুরো এলাকা রক্তে একাকার হয়ে গেছে। যানবাহন নিয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এর আগেও ইসরাইল ও ইউরোপের কয়েকটি স্থানে ঘটেছে। তবে নিস শহরের মতো এত ব্যাপক হতাহতের ঘটনা সেসব স্থানে ঘটেনি। একত্রিশ বছর বয়সী তিউনিসিয়ার বংশোদ্ভূত মুসলিম ট্রাকচালকটির সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের যে যোগাযোগ রয়েছে তা পুলিশের জানা ছিল। কিন্তু আগে থেকে চালক নজরদারির মধ্যে ছিল না। চালক ছাড়া এই ঘটনায় সরাসরি আর কেউ জড়িত কী না তা এখনও জানা যায়নি। তবে চালকের সাবেক স্ত্রীসহ ৫ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত বছরের ১৩ নবেম্বরে রাতের প্রথম প্রহরে বিশ্বের মনোরম ও সুন্দরতম নগরী হিসেবে খ্যাত ফ্রান্সের রাজধানী যেভাবে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি বোমা হামলা ও গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল, তা ভয়ঙ্কর, নজিরবিহীন, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল। ছয়টি স্থানে প্রায় একই কায়দায় ভয়াবহ জঙ্গী হামলায় ১৩২ জন মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং বিপুলসংখ্যক আহত হওয়ার ঘটনা ছিল মর্মস্পর্শী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে ফ্রান্সে। এর আগে ২০১৫ সালের সাত জানুয়ারিতে ব্যঙ্গচিত্রের পত্রিকা শার্লি এবদো কার্যালয়ে জঙ্গী হামলা চালানো হলে ১১ জন নিহত হয়। ইতোপূর্বে ২০০৪ সালে স্পেনের মাদ্রিদে ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৯১ জন। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে হামলা হয়েছে নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও তুরস্কে। গত নবেম্বরে প্যারিস হামলার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে আইএস ভিডিও বার্তা প্রচার করে আরও হামলার হুমকি দিয়েছিল। জবাবে ফরাসী প্রেসিডেন্ট হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, হামলার জবাব দেয়া হবে। কিন্তু দেশে অবস্থানরত জঙ্গিদের চিহ্নিত করা যায়নি। এর পাশাপাশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু সেই অঙ্গীকার ঘোষণাতেই মিলিয়ে গেছে। প্যারিস হামলার অন্যতম জঙ্গী সালাহ আবদেল সালামকে ধরতেই প্রায় ছ’মাস লেগেছে। ব্রাসেলসের যে স্থান থেকে তাকে ধরা হয়েছিল তার কয়েকটি বাড়ি পরেই সালামের মূল বাড়ি। এতে স্পষ্ট যে, স্থানীয় সমর্থন না থাকলে; গোয়েন্দাদের এত সক্রিয়তা সত্ত্বেও এভাবে লুকিয়ে থাকা ছিল অসম্ভব। তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এই বিচ্ছিন্নতা হামলা সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। আইএসবিরোধী কোয়ালিশনের একটি শরিক দেশ হয়েও ফ্রান্স নিজ দেশের জঙ্গীদের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি চালু করতে পারেনি। পত্রিকা শার্লি এবদোর ঘটনার পরে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে ফ্রান্স তৎপরতা দেখিয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু নিজ দেশের খবর রাখতে সেভাবে উদ্যোগী হয়েছে বলা যাবে না। ফলে নবেম্বরে পুনরায় হামলা হয়। হামলাকারীরা ফরাসী সমাজের পিছিয়ে পড়া, বিচ্ছিন্ন পর্যায়ের থেকে ওঠে আসা। জঙ্গী হবার আগে এরা নানা অপরাধে জড়িত ছিল। শার্লি এবদোর ঘটনার পর ফরাসীরা রাজপথে নেমেছিল জঙ্গীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেøাগানে প্ল্যাকার্ডেই ছিল সব সীমাবদ্ধ। এবারের ঘটনার দায় একদিন পর আইএস স্বীকার করলেও ফ্রান্স আগেই ধরে নিয়েছে, এটা আইএসের কাজ। অতএব প্রতিশোধ নিতে সিরিয়া, ইরাকে আইএস ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালাবে। কিন্তু নিজ দেশকে জঙ্গীমুক্ত করার ক্ষেত্রে সফল হবে কি না, সে নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ মুসলিম, যা ইউরোপের মধ্যে সর্বাধিকসংখ্যক। তিউনেসিয়া, শাদ, মরক্কো, আলজিরিয়ার মতো পশ্চাদপদ মুসলিম দেশ থেকে উন্নত জীবনযাত্রার জন্য অনেকেই ফ্রান্সে অভিবাসী হয়েছেন। দীর্ঘদিন বসবাস করলেও ফ্রান্সের মূল সমাজ ব্যবস্থা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন প্রায়। শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরি-বাকরি, এমনকি নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত তারা। এদের একাংশের মধ্যে সহজে জঙ্গী মতবাদ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে আইএস; বিশেষত তরুণদের মধ্যে। এই যে সমাজ বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী, তাদের দিকে যথাযথ নজর দেয়া হয়নি। আর তা না হবার কারণে এরা জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। যে কারণে ফ্রান্স থেকে সিরিয়া যাওয়ার প্রবণতা গত দুইবছর ধরেই বেড়েছে। এ পর্যন্ত ইউরোপ থেকে ছয় হাজারের বেশি যুবক সিরিয়ায় গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গিয়েছে ফ্রান্স থেকে। এই সমাজ বিচ্ছিন্নদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজটি সহজ নয়। এদের মন থেকে মানুষ হত্যার মনোভাব দূর করা আরও কঠিন। শিল্প ও শিল্পীদের পীঠস্থান বলে খ্যাত ফ্রান্স আজ ভয়ের সংস্কৃতিতে আক্রান্ত। রম্য পত্রিকা শার্লি এবদো অনেকটাই উস্কে দিয়েছিল ব্যঙ্গ কার্টুনচিত্র এঁকে ধর্মান্ধ জঙ্গীদের। এরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পত্রিকার দফতরে হামলা চালিয়ে ১০জন কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক এবং পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যা করেছিল। ঘটনার পরপর বিশ্বজুড়ে এই হামলার নিন্দা এবং নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংহতি প্রকাশ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে প্যারিসের রিপাবলিক চত্বরে সমবেত হয়েছিল লাখ পনেরো মানুষ। একাত্মতা প্রকাশ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন অন্তত চল্লিশটিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। তাৎক্ষণিক এই বিপুল প্রতিক্রিয়া ও সংহতি বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদের জন্য ছিল এক কঠোর হুঁশিয়ারি। এর মাধ্যমে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব একতাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ছিল ভিন্ন। এরপরও পুনরায় গত নবেম্বরের হামলার ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিল, ফ্রান্সের ঘোর দুর্দিন এখন। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ যে ঘটেনি দেশটির, তা ১৪ জুলাইয়ের নির্মমতা প্রমাণ করেছে। ফ্রান্সে হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলো শুধু মর্মান্তিক বলে বর্ণনা করলে সবটা বোঝানো যায়, তা নয়। সংগঠিতভাবে চালালে এই হামলাগুলো মূলত দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল। এগুলো আইএস বা আল কায়েদার আদর্শে অনুপ্রাণিত ফরাসী জঙ্গীগোষ্ঠীর চালানো হামলা হলেও বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। হামলা যারাই পরিচালনা করে থাকুক না কেন, তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা মানবতাবাদী নয়, প্যারিস, ব্রাসেলস, ইস্তানবুুল, ঢাকার পর নিসের এই হামলা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। নিসের হামলার দায় প্রথমে আইএস স্বীকার না করলেও সামাজিক মাধ্যমে নিস হামলার প্রতি অভিনন্দন অব্যাহত ছিলো সমর্থকদের। নিস এটাক হ্যাশ ট্যাগ সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি করে। আইএসের ডিজিটাল সমর্থকরা তা ছড়িয়ে দেন। ফ্রান্সের জাতীয় দিবসে একটি ট্রাককে হামলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়ার বিষয়টি গোয়েন্দা ও পুলিশের ধারণায় আসেনি। বিশেষজ্ঞরা এই হামলাকে ‘লোন উলফ এটাক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যার অর্থ হচ্ছে একক প্রচেষ্টায় ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। এটা আইএসের নিজস্ব উদ্ভাবিত কৌশল। সম্প্রতি ইরাকী সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয় আইএসের যুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আবু ওমর আল শিসানি। তার মৃত্যু আইএসের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ধারণা করা হচ্ছে, শিসানির মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবেই নিসে এই হামলা চালিয়েছে আইএস। অস্ত্র বোঝাই ট্রাক দ্রুতবেগে পিষে দিল ৮৪ জনকে। আহত হলেন আরও অর্ধশতাধিক। ভিড়ে ঠাসা দুই কিলোমিটার সড়কজুড়ে সবেগে চলাকালে কন্টেনার বোঝাই ভারি ট্রাকটিকে নিবৃত্ত করতে পুলিশ খুব উদ্যোগী হয়েছিল, তেমনটা বলা যাবে না। বরং তারা অনেকটাই হতভম্ব মনে হয়েছে। রাত ১১টার এই ঘটনার ভয়াবহতা টিভি দর্শককে সহ্য করতে হয়েছে। একক এই হামলা আরও আশঙ্কার তৈরি করেছে যে, জঙ্গী আদর্শে দীক্ষিত কোন যুবক যে কোন সময় যে কোন স্থানে হামলা চালাতে পারে। তাদের কাছে থাকা যে কোন জিনিসই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং আসল হামলা ঠেকানো খুব শক্ত। তদুপরি এভাবে একটি হামলা সফল হলে অন্য জঙ্গীদের মধ্যে এই ধরনের হামলা চালানোর উৎসাহ বাড়ায়। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরেও ফ্রান্স আইএস জঙ্গী ঠেকাতে পারছে না। তার রয়েছে সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ উত্তর আফ্রিকার দেশ থেকে আসা শরণার্থীর চাপ। যাদের মধ্যে আইএস জঙ্গীদের অবস্থান থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তাই চাইলেই জঙ্গীদের নির্মূল করা সহজ নয়। ফ্রান্সে হামলার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের নেটওয়ার্ক কাজ করেছে। যা স্পষ্ট করে আইএস ফ্রান্সে তাদের সমর্থনও সন্ত্রাসী জাল বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। আইএসের অর্থ ও অস্ত্র বলের যোগানদাতাদের চিহ্নিত ও নিবৃত্ত করা না গেলে এদের দাপট বাড়তেই থাকবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সবাই এককাট্টা আজ। কিন্তু বাস্তবে এই ইস্যুতে এক হতে পারছে না। ফলে আইএস ইরাক ও সিরিয়া থেকে পিছু হটলেও ইউরোপে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে। তবে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটেনে তারা কোন হামলা চালায়নি। বলা হয় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আখড়া ব্রিটেনে। সেখান থেকেও অনেকে সিরিয়া গিয়েছে আইএসে যোগ দিতে। ফরাসী সরকার সব সময় দাবি করে আসছে, দেশটি নিরাপদে রয়েছে। কিন্তু জঙ্গীরা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা নিরাপদ নয়। জরুরি অবস্থার মধ্যে এরকম হামলার ঘটনা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনা দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। যা কারও কাম্য নয়। আজ হোক, কাল হোক ইরাক ও সিরিয়াতে আইএসের পতন হবে। আইএসকে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও জঙ্গীদের মনভূমি থেকে জঙ্গীবাদ মুছে ফেলা সহজতর হবে না। কেন বার বার ফ্রান্সে হামলা হচ্ছে, তা সংশ্লিষ্টদেরই খতিয়ে দেখতে হবে। আক্রমণ যখন বহুমাত্রিক তখন তার মোকাবেলায় লড়াই বা প্রতিরোধের চরিত্রকেও হতে হবে বহুমাত্রিক। আর এই বহুমাত্রিক লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার মতাদর্শ। নাট্যজন ব্রেখটের ভাষায়, মানুষের কাছে মতাদর্শের এই হাতিয়ার তুলে দিতে হবে। মানুষের কাছে মতাদর্শ নিয়ে যেতে হবে। কেননা মানুষই ইতিহাস গড়েন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশজুড়ে যখন জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসবাদীরা রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় হামলা চালাচ্ছে, তখন জনগণের ভূমিকা হবে আরও কঠিন, আরও গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সে আইএস যে ঘটনা ঘটাচ্ছে, বাংলাদেশে সেই শক্তির কার্যক্রম নেই। রয়েছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতের সন্ত্রাসী তৎপরতা। আজকে একটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি দেশবাসী। প্রায়শই আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। মানুষের রুটিতে, রুজিতে আক্রমণ চলছে। গোটা দেশজুড়ে জঙ্গীবাদী শক্তির উত্থান ঘটাতে চাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা। ফ্রান্স যেখানে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে সিরিয়া, ইরাকে। বাংলাদেশ সেই অবস্থানে নেই। তারপরও কেন এদেশে জঙ্গী হামলা হচ্ছে, সে প্রশ্নের জবাব তো সবারই জানা। আর সেই রাজনৈতিক শক্তিকে দমানো সর্বাগ্রে জরুরী। নতুবা ট্রাক হামলা এদেশেও ঘটাতে পারে তারা।
×