ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ আমাদের আইসিটি আমাদেরই মেধা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১২ জুন ২০১৬

একুশ শতক ॥ আমাদের আইসিটি আমাদেরই মেধা

১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল যখন কম্পিউটারের বোতামে হাত রাখি তখন এই যন্ত্রটি ছিল আমার হাতের কলমটার বিকল্প। সেটি দিয়ে বাংলা লিখে জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের অনুভূতির সন্ধান পেলাম। আস্তে আস্তে কম্পিউটার যন্ত্রটি তুলির বিকল্প, সিনেমা দেখার, ভিডিও সম্পাদনার, গান শোনার বা গেম খেলার যন্ত্র হতে থাকে। তখন ওয়ার্ড স্টার, লোটাস ১২৩ ও ডিবেসের যুগ। আমি কখনও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোথাও কম্পিউটার দেখতে যেতাম না। ডসের সিনটেক্স মনে রাখতে পারতাম না- তাই পিসি ছুঁয়েও দেখিনি। আমি তথ্যপ্রযুক্তি দেখতাম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান; বাংলা বাজারে, পত্রিকা অফিসে বা বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ধীরে ধীরে অনুভব করলাম কম্পিউটার তো প্রচলিত সবই বদলে দিচ্ছে। সেই অনুভবকে বললাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে দেখলাম বিশাল এক আকাশ। ঘর থেকে পা বাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কি বিশাল সেই নীল। সামনের প্রান্তরের সবুজ আমাকে সীমাহীন সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিল। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিটি মানুষের কাছেই সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এক পরম সম্ভাবনার গল্প তৈরি করেছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন দেখার প্রায় সাড়ে সাত বছর পর কেমন জানি লাগছে। দেশ বদলাচ্ছে, সব কিছুই ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা আকাশ ভরা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে ডিজিটাল রূপান্তরে আমাদের স্বপ্নও বড় হবে তাদের মাঝে এখন বিরাজ করে এক ধরনের হতাশা। খুব সহজ কথায় এর প্রধান কারণ দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে আমরা স্বপ্নবাজরা নিজেরা অংশ নিতে সুযোগ পাই না। সত্যি কথা হচ্ছে সরকারের বড় বড় ডিজিটাল রূপান্তরের কাজগুলো করছে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা আন্তর্জাতিক টেন্ডারের নামে, টেন্ডারের শর্ত পূরণের নামে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পুরো বাজারটাই দখল করে নিচ্ছে। কোথাও কোথাও দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহযোগী, আংশিক কাজ করতে পারলেও আমরা আমাদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ফলে বিশাল নীল আকাশটায় আমরা পাখা মেলতে পারি না- বিদেশী কাক চিল শকুনে ভরে যাচ্ছে আমাদের আকাশ। ॥ দুই ॥ সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এই বছরেই বাজেটে ৬২২ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছে। এই অর্থের বিনিময়ে আমরা আমাদের ডিজিটাল যাত্রাকে আরও বেগবান করব। এজন্য আমরা সংগ্রহ করব কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার এবং সেবা। একদম সহজ-সরলভাবে একটি কথা আমরা বলতে পারি যে, দেশে কম্পিউটার উৎপাদন বা সংযোজন না হওয়ার ফলে আমাদের সকল হার্ডওয়্যার কেনাকাটায় বলা থাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কম্পিউটার হতে হবে। এই একটি শর্তই বাংলাদেশে উৎপাদিত বা সংযোজিত কোন ডিজিটাল যন্ত্রকে সরকারী টেন্ডারে অংশ নিতে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদের দেশীয় পণ্য দোয়েল তো আর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নয়; তাই প্রথমেই দোয়েল বাদ। আমরা বিদেশী সফটওয়্যার কেনায় এতো সিদ্ধহস্ত যে, হাজার হাজার টাকায় নাম ধরে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম কিনি; কিন্তু ভুলেও কোন দেশী সফটওয়্যারকে যুক্তই করি না। এমনকি এক শ’ টাকার দামের সফটওয়্যার না কিনেও আমরা অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার কিনি। সরকারের কেনাকাটায় উইন্ডোজ অরিজিনাল সংস্করণ যদি থাকে তবে কম্পিউটারের জন্য আলাদাভাবে এ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যার কেনার দরকার নেই। এটি উইন্ডোজের সঙ্গে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি কেনা হয়ই। আমি নিশ্চিত জানি যে, এই কেনাকাটার পেছনে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। এই বিষয়গুলো বহুদিন ধরে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাণিজ্য সংগঠন বেসিস আলোচনার টেবিলে এনেছে। বিসিএস বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায়নি তার প্রধান কারণ আমরা বিদেশী পণ্যের পরিবেশক বা বিক্রেতা। ফলে দেশের উৎপাদন আমাদের কাছে কোন বিষয়ই নয়। যদিও বাংলাদেশের ডেস্কটপ বাজার সংযোজিত কম্পিউটারের দখলে এবং ব্র্যান্ডের ডেস্কটপ কেবল সরকারই কিনে থাকে, তবুও সরকারী কেনাকাটায় আমাদের ছোট বা মাঝারি বিক্রেতারা তাদের বার্ষিক টার্নঅভারের ও অন্যান্য শর্ত পূরণ করে অংশ নিতে পারে না। বেসিস বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু যতক্ষণ সরকারের কেনাকাটার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য কেনার বিষয়টি বিশেষায়িতভাবে দেখা না হবে ততক্ষণ বিদ্যমান প্রচলিত ব্যবস্থা বদলাবে না। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সকল বিষয় নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। সকল সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বিদেশী আগ্রাসন সমভাবেও নেই। আমরা আমাদের ইআরপি সফটওয়্যারের জগতে তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। তবে এই খাতে বিদেশী আগ্রাসন যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু যেহেতু আমাদের মেধাজাত সম্পদ কারিগরি দিক থেকে উন্নত এবং আমাদের সঙ্গে বিদেশীরা দামে কুলিয়ে উঠতে পারে না, সেহেতু এর সিংহভাগ আমাদেরই দখলে। আমাদের বাংলা ভাষার সফটওয়্যার বাজারে বিদেশীরা সামান্যতম সুই প্রবেশ করাতে পারেনি। আমাদের শিক্ষামূলক ডিজিটাল কনটেন্টের ক্ষেত্রেও বিদেশীরা কোন আঁচড় কাটতে পারেনি। তবে ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজ করে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে। দেশের হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকি সবাই শত শত কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকিং সফটওয়্যার কিনছে। এই কেনাকাটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। অভিযোগ আছে যে, সফটওয়্যার কেনার নামে এর কর্মকর্তা ও পরিচালকরা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও পাচার করছে। ব্যাংক খাতের এই তস্করদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্যরা কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এসব অনাচার দেখেও না দেখার ভান করেছে সবাই। এমনই এক অবস্থায় আমার জন্য একটি চমৎকার সুযোগ আসে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা জানার। আসুন আমার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি ঘুরে আসা যাক। ॥ চার ॥ ৯ জুন ১৬ আমি আমার ছোট একটি দল নিয়ে বেসিসের একটি সদস্য কোম্পানির অফিসে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল (এ্যাডভান্স ইআরপি (বিডি) লিঃ), এ কে এম আহমেদুল ইসলাম (এটম এপি লিঃ) এবং দেলোয়ার হোসাইন ফারুক (রেডিশন ডিজিটাল টেকনোলজিস লিঃ)। আরও থাকার কথা ছিল ফারহানা এ রহমান (ইউওয়াই সিস্টেমস লিঃ), রাসেল টি আহমেদ (টিম ক্রিয়েটিভ), এম রাশিদুল হাসান (সিস্টেক ডিজিটাল লিঃ), রিয়াদ এসএ হুসেইন, (ম্যাগনিটো ডিজিটাল) এবং উত্তম কুমার পালের, (বেস্ট বিজনেস বন্ড লিঃ)। বেসিসের নির্বাচন মৌসুম বলে দল বেঁধে এই পথচলা। আমার নিজের জন্য এটি একটি বিশাল বড় অভিজ্ঞতা। এর আগে বিসিএস-বেসিসের অনেক নির্বাচন করেছি; কিন্তু কখনও ভোটারদের সঙ্গে এত সময় নিয়ে এভাবে মতবিনিময় করা হয়নি। ফোনে দু’চারটা কথা বলা বা কোন বিশেষ স্থানে হাত মেলানোই ছিল আমার নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান ধারা। এবার তার ব্যতিক্রমটা নিজেই আগ্রহ ভরে গ্রহণ করেছি। নির্বাচনে হার-জিত যাই হোক এর ফলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবস্থাটা কেমন সেটি জানা যাবে। সেই সূত্র ধরেই সেদিন দুপুরে বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠান এরা-এর অফিসে প্রবেশের আগে ভাবতেই পারিনি বাংলাদেশের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এমন চমৎকার ও নিরাপদভাবে সাজানো হতে পারে। পুরো অফিসের চিত্রটা মনটা ভরিয়ে দিল। গত ক’দিনে আমি আমাদের এই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান দেখেছি। কেউ বিদেশে কাজ করেন, কেউ দেশের জন্য কাজ করেন। এদের সবাইকেই মনে হয়েছে যে, সম্ভবত সামন্ত যুগ, কৃষি যুগ বা স্বাধীনতা-উত্তর মধ্যবিত্ত যুগটা আমাদের এসব উদ্যোক্তা পার হয়ে এসেছেন। আগ্রহ নিয়ে এমডি মহোদয়ের কাছে জানতে চাইলাম কিসের কাজ করেন। সিরাজুল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠানের এমডি। তিনি জানালেন, ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করেন। আমি জানতাম টেকনোহ্যাভেনের করিম ভাই, লিডসের আজিজ ভাই, ফ্লোরার ইসলাম সাহেবের আগে বাংলাদেশে ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করেছে বেক্সিমকো। জীবনে যখন প্রথম এই জগতে পা দিই সেই ৮৭ সালে তখনই বেক্সিমকোর সফটওয়্যারটির নাম শুনেছি। বেকিস ব্যাংকের নাম শুনলে বুকটা বড় হয়ে যেত। সেই দেশে এখন ব্যাংকিং সফটওয়্যার মানে বিদেশী সফটওয়্যার। সিরাজ সাহেব খুব নরম সুরেই বললেন, শত শত কোটি টাকায় যেসব বিদেশী সফটওয়্যার আমদানি হয়, যার শতকরা ১০ ভাগও কেউ ব্যবহার করতে পারে না। এমনকি দেশের ব্যাংকিং আইনকেও এসব সফটওয়্যার সমর্থন করে না। একেবারে স্পষ্ট করে বলা উচিত যে, আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশ্বের অন্য সকল দেশের সঙ্গে হুবহু মিলে না। ঐসব সফটওয়্যার কাস্টমাইজ না করে দেশের সঙ্গে তাল মেলানো যায় না। অন্যদিকে এসব সফটওয়্যারের সাপোর্ট পেতে হয় বিদেশ থেকে। সেই সাপোর্ট কখনও জোটে কখনও জোটে না। সিরাজ সাহেব জানালেন, শত কোটি টাকার বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে তার প্রতিষ্ঠান মাত্র ২ কোটি টাকায় ব্যাংকিং সফটওয়্যার দিয়েছিলেন। ব্যাংক এশিয়া ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকসহ দেশের অনেক ব্যাংকের কোর ব্যাংকিংয়ের কাজ তাদের তৈরি করা সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালনা করা হয়। তারা মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংও করেন। এমনকি তাদের রয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং সফটওয়্যার। এই প্রতিষ্ঠানটিকে দেখে মনে হলো আমরা একদিন সকল কাজ আমাদের সন্তানদের তৈরি করা সফটওয়্যার দিয়েই করতে পারব, বিদেশীদের প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলার সন্তানদের জন্য, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য। প্রসঙ্গটি শেষ করার আগে সরাসরি কিছু প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই। প্রথমত. সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি কেনাকাটাকে আলু-পটল কেনার মতো বিধিবিধান দিয়ে বন্দী না করে সরকারের উচিত তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সেবা সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষায়িত নীতিমালা প্রণয়ন করা। এই নীতিমালার প্রধান লক্ষ্য হবে দেশীয় পণ্য ও সেবা সংগ্রহ করা এবং দেশীয় পণ্য ও সেবা দিয়ে বিদেশী পণ্য ও সেবাকে প্রতিস্থাপিত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন কঠোর আইন করা দরকার যে, দেশে যেসব হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বা সেবা পাওয়া যাবে তা বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে না। যদিওবা আনতে হয় তবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, আইসিটি মন্ত্রণালয়, বেসিস ও বিসিএস-এর যৌথ কমিটির অনুমোদন লাগবে এবং তার ওপর উচ্চহারে কর ও ভ্যাট দিতে হবে। ঢাকা, ২৭ মে, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×