ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুর জাদুঘর

আহসান মঞ্জিলের আদল শৈল্পিক মডেল, তাজহাট জমিদারবাড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২ জুন ২০১৬

আহসান মঞ্জিলের আদল শৈল্পিক মডেল, তাজহাট জমিদারবাড়ি

তাহমিন হক ববী ॥ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যম-িত অসংখ্য মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় রয়েছে মনুষ্যনির্মিত বহু ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। চোখ ধাঁধাঁনো এসব বিস্ময়কর স্থাপত্যকলার নিদর্শনে আবার কোন না কোনভাবে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস অথবা পৌরাণিক কাহিনী। ভ্রমণপিপাসু অনেকেই আছেন, যারা নানা কাজের ভিড়ে একটু সময় বের করে বছরে একবার হলেও ঘুরে দেখেন বা দেখতে পছন্দ করেন বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান। ঘুরে বেড়ানো যারা ভালবাসেন তাদের জন্য চমৎকার একটি স্থান রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি, যাকে সবাই বলে থাকেন শৈল্পিক মডেলরূপী জমিদারবাড়ি; যা এখন রংপুর জাদুঘর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রতœ ব্যবসায়ী মান্না লাল তদানীন্তন রংপুর অঞ্চলে তাজহাট জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। ব্যবসায়িক কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে তিনি রংপুরের মাহিগঞ্জে এসে বসবাস শুরু করেন এবং একটি ভবন নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিক¤েপ তার এ ভবনটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনি আহত হয়ে পরবর্তীতে মারা যান। তার দত্তক পুত্র গোপাল লাল রায় বাহাদুর জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান ভবনটির নির্মাণ শুরু করেন। এজন্য দক্ষ নক্সাকার ছাড়াও সবমিলিয়ে কাজ করেন প্রায় দুই হাজার রাজমিস্ত্রী। ১৯১৭ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় এবং সে সময়ের হিসাবে এতে খরচ হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। ইতালি থেকে আমদানিকৃত শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ বাড়ির সম্মুখের সিঁড়ি। এছাড়া ভবনের প্রধান প্রধান অংশগুলো নির্মাণে ব্যবহার করা হয় লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর। পুরো ভবনটিতে রয়েছে ২৮ কক্ষ। ভবনের সামনে মার্বেল পাথরের সুদৃশ্য একটি ফোয়ারা আজও বিদ্যমান। বাড়িটির চারদিকে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা বহন করা ফুলের বাগান এবং উত্তর ও দক্ষিণাংশে কামিনী, মেহগনি, কাঁঠাল ও আমবাগান। ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো দেখতে এই জমিদার বাড়িটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় রয়েছে রাজা গোপালের ব্যবহৃত নানা জিনিস। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এ বাড়ি চলে যায় কৃষি বিভাগের অধীনে এবং এখানে গড়ে ওঠে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাড়ির প্রচুর মূল্যবান স¤পদ খোয়া যায়। ১৯৮৫ সালে এখানে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ চালু হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে তাজহাট জমিদারবাড়ি রূপান্তর করা হয় জাদুঘরে। আর এর বর্তমান নাম রংপুর জাদুঘর। এ জাদুঘরের তিন শ’ মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে। প্রতিদিন শত-শত দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এটিকে ঘিরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রয়েছে মহাপরিকল্পনা। এই জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান আবু সাঈদ ইনাম তানভিরুল জানান, এটি বাস্তবায়ন হলে দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তাজহাট জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার মান্না লাল রায়। তিনি ভারতের পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন। প্রথমদিকে পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। স্বর্ণখচিত টুপি কিংবা তাজ নির্মাণ করাই এ অঞ্চলের নাম হয়েছে তাজহাট। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি পুরো একটি পরগনা কিনে নিয়ে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। রংপুর শহর থেকে পূর্বদিকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থান তাজহাট জমিদার বাড়ির। ৫৬ একর এলাকাজুড়ে পূর্বমুখী দোতলা এ ভবনটি প্রায় ৭৭ মিটার দৈর্ঘ্য। বাড়ির সামনের দিকে রয়েছে বড় একটি দালান। এতে ওঠার জন্য আছে শ্বেতপাথরে আবৃত দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি। বাড়ির ছাদের মূল অংশে আট কোণা পিলারের ওপর রেনেসাঁ গম্বুজ। এ গম্বুজের বৈশিষ্ট্য এটি আংশিকভাবে সরু পিলারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িটিতে গাড়ি রাখার বারান্দা প্রায় ১০ মিটার দীর্ঘ। এর ওপরে যে ঝুল বারান্দা রয়েছে, তার ছাদ চারটি পিলারের ওপর অবস্থিত। দুই প্রান্তের বারান্দায়ও রয়েছে ত্রিকোণাকৃতির ছাদ। ভবনে ১৯ মিটার দৈর্ঘ্যে ও ১৪ মিটার প্রস্তের বিশাল হলঘর। এর দুই দিকে রয়েছে একটি করে ঘর। ভেতরে আছে তিন মিটার প্রশস্ত টানা বারান্দা। প্রধান ফটকের উত্তর দিকের দোতলায় বিশাল একটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। ১৯৯৫ সালে এটিকে প্রতœসম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০০২ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে এটি ১৬ দশমিক ০৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাকি জমিতে কৃষি ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। এই জাদুঘরে রয়েছে তিন শ’র বেশি মূল্যবান নিদর্শন। প্রতিদিন দেশী ও বিদেশী পর্যটকরা এই বাড়ির সৌন্দর্য দর্শনে আসেন। প্রবেশমূল্য বড়দের ১০ টাকা, শিশুদের ৫ টাকা। বিদেশী পর্যটকদের জন্য প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। রংপুর জাদুঘরের গ্রীষ্মকালীন সময়সূচী (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। মাঝে দুপুর একটা থেকে ত্রিশ মিনিট বিরতি। আর শীতকালীন (অক্টোবর-মার্চ) সময়সূচী সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি। রবিবার পূর্ণ দিবস ও সোমবার অর্ধ দিবসসহ সরকারী সব ছুটির দিনে জাদুঘর বন্ধ থাকে।
×