ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা আদম, মানুষ নয়!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৮ মে ২০১৬

ওরা আদম, মানুষ নয়!

ফিরোজ মান্না ॥ ওদের শ্রম-ঘামেই তো দেশে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। রেমিটেন্স বাড়ছে, দেশের উন্নতি হচ্ছে। তবু কেন ওদের প্রতি এত অসম্মান। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে ওদের মানুষ হিসেবেই ভাবা হয় না। আর দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘আদম’ বলে ডাকা হয়। এখানেও প্রায় একই রকম ব্যবহার। কোন্ দোষে ওদের প্রতি এই আচরণ। বছরের পর বছর মালয়েশিয়ায় কাজ করে দেশে ফেরার সময় এমন ব্যবহার তারা আশা করেন না। নিকটজনের জন্য কিছু কেনাকাটা করে আনাও তাদের যেন অপরাধ। লাগেজটা দেখলেই বিমানবন্দরে কর্মকর্তা- কর্মচারীর চোখ টগবগিয়ে ওঠে। মনে করেন লাগেজটার মালিক যেন তারাই। সরাসরি লাগেজ না নিলেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কর্মীদের কাছ থেকে। বিমানবন্দরে এমন দৃশ্য সব সময় চোখে পড়ছে। তাদের সঙ্গে এমন অপমানজনক ব্যবহার চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে সম্প্রতি ইমিগ্রেশনে দেশটির কর্মকর্তা- কর্মচারী বাংলাদেশী কর্মীর সঙ্গে যেভাবে অসম্মানজনক ব্যবহার করলেন তা সত্যিই পীড়াদায়ক। তাদের এমন অসৌজন্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার নেই। এটা নাকি নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশী কর্মীর ওপর এমন ব্যবহার চলে। কর্মীর কেউ যদি কোন প্রতিবাদ করেন, তাহলে তার কপালে খারাপই ঘটে। খারাপ কিছু থেকে মুক্ত থাকতেই কেউ কোন প্রতিবাদ করেন না। মুখ বুঁজে সব দুর্ব্যবহার সহ্য করে কোন রকমে ইমিগ্রেশন পার হতে পারলেই যেন মুক্তি। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা তো আর কেউ দুর্ব্যবহার করবে না। উড়োজাহাজে এই তিন ঘণ্টা শান্তিতে বসে থাকা যাবে। অথবা ক্লান্তির ঘুম ঘুমানোটাই হবে সার্থকতা। ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ভাগ্য বদল করতে। প্রথমেই ভাগ্য বদলের হাওয়া লাগে এয়ারপোর্টে। এখান থেকেই শুরু হয় অপমান অসম্মান। গায়ে এমন অপমান নিয়ে নামেন মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্টে। সেখানে তারা হয়ে পড়েন রীতিমতো অসহায়। তাদের ওপর অপমানের পাহাড় গড়ে উঠতে থাকে। অপমান অসম্মান নিয়ে তারা দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়ার পাম বাগানে অথবা কোন ফার্নিচার কারখানায় কিংবা কোন মার্কেটে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। সব সময় পুলিশের ভয় মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করে মালয়েশিয়ায় এসে এত ছোট কাজ করতে হবে তা বুঝে ওঠার আগেই বন্দী হয়ে পড়েন দালাল চক্রের জালে। জালে জড়ানোর পর তাদের আর কিছু বলার বা করার থাকে না। বাধ্য হয়ে নিজেকে পরিস্থিতির শিকার হিসেবে মেনে নিয়ে কাজ যত ছোটই হোক না কেন তারা করতে শুরু করেন। তারপর দিন মাস বছর কেটে যায়। দিনরাত ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে দেশী মুদ্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকায় তারা সেখানে থাকা, খাওয়া, জীবনযাপন করেন। এখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে দেশে মা-বাবাকে পাঠান। টানা তিন বছর কাজ করে দেশে ছুটিতে আসেন কেউ কেউ। আত্মীয়-স্বজনের জন্য এটাসেটা কেনেন। সেগুলো ভাল করে স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে এয়ারপোর্টে আসার পরই বিড়ম্বনা শুরু হয়। সেই বিড়ম্বনার শেষ ধাক্কা লাগে ঢাকায় ট্যাক্সি পর্যন্ত। ট্যাক্সিওয়ালাও তাদের কাছ থেকে গলা কাটে। ৫শ’ টাকার ভাড়া ২ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কর্মীদের কোথাও কোন মূল্য নেই। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে কর্মীদের হাত ব্যাগ খুলে তছনছ করা হয়। ৭ কেজির ওপর এক শ’ গ্রাম ওজন বেশি হলে গুণতে হয় ১৭ রিঙ্গিত। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি। এজন্য শুনতে হয় নানা কথা। লাইনে দাঁড়ানো নিয়েও তাদের নানাভাবে অপমান করা হয়। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট পার হয়ে যখন ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন তখন শুরু হয় আরেক বিড়ম্বনা। ঢাকায় নেমে ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়াতে গিয়েই শুরু হয় অপমানের পালা। প্রবাসী বাংলাদেশী লেখা কাউন্টার দিয়ে তাদের ইমিগ্রেশন হবে। অন্য কোন লাইনে দাঁড়ালে তাদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করা হয়। দেশের মানুষের কাছ থেকে গালাগাল শুনতে তাদের কষ্ট লাগে। বিদেশীরা গালিগালাজ করে সেটা সহ্য করা যায়। কিন্তু দেশের মানুষ যখন গালাগাল দেয় তখন আর ভাল লাগে না, প্রতিবাদের ইচ্ছে করে। এমন কথা বললেন বেশ কয়েক কর্মী। ঘটেও তাই। বছরের পর বছর দুর্ব্যবহার সহ্য করে দেশে ফিরে যদি এ রকম ব্যবহার পাওয়া যায় তাহলে কার না রাগ হবে? এক বিন্দু সম্মানও দিতে চায় না কেউ। কি যে পাপ করেছিলাম। বিদেশে কাজ করি বলে এমন ব্যবহার করবে আমাদের সঙ্গে, এটা কেমন কথা! ২১ মে রাতে কুয়ালালামপুর থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কয়েক শ’ কর্মী দেশে ছুটিতে আসেন। তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা হলো। মালয়েশিয়ায় কে কি কাজ করেন। তাদের কাজের কথা শুনে মনে হলো কত ঘাম-শ্রম দিয়ে দেশে তারা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। ভোরে ইমিগ্রেশন শেষ করে যখন লাগেজের জন্য অপেক্ষা তখন দেখা গেল আরেক অনিয়ম। কর্মীদের লাগেজ বেল্টে পড়ার আগেই হাতে পৌঁছে দেবেন এমন কথা বলে ২০ থেকে ৩০ রিঙ্গিত (মালয়েশিয়ার মুদ্রা) হাতিয়ে নেয়া হয়। কয়েকটি লাগেজ অন্য পথেও এনে দেয় এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা কর্মীসহ অন্যরা। পরে যখন কয়েক কর্মী বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ শুরু করেন তখন অবৈধ পথে লাগেজ দেয়া বন্ধ হয়। লাগেজ পাওয়া শেষ হওয়ার পর এয়ারপোর্টের বাইরে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা। বিদেশ ফেরত কর্মীদের দেখেই ট্যাক্সি চালকরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া হাঁকেন। কি আর করা, ট্যাক্সি চালকদের ইচ্ছেমতো ভাড়ায় তাদের যেতে হচ্ছে। ঘাটে ঘাটে এমন বিড়ম্বনা সহ্য করে কর্মীদের স্বজনের কাছে পৌঁছতে হচ্ছে। এই বিড়ম্বনার শেষ কোথায় তা জানেন না কেউ।
×