ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ভৌগোলিকভাবে নাজুক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। কারণ বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দুটি উনিশ শ’ চৌত্রিশ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়া বা ভূমিকম্পের। ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া নেপালের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। এই ভূমিকম্পের হাইপোসেন্টার বা ভূগর্ভস্থ উৎসস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৮.২ কিঃ মিঃ গভীরে। এত উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠের এত কাছে সংঘটিত হওয়ায় নেপালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অবর্ণনীয়। এই ভূমিকম্পে হাজার বছরের যে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হারিয়েছে নেপাল, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ বরণের আগের দিন ঘটল মিয়ানমারে ভূমিকম্প। ৬.৯ ছিল মাত্রা। ভূপৃষ্ঠ থেকে এই ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ১৪০ কিঃ মিঃ। উৎসস্থল অনেক গভীরে হওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালে এই ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হলেও খোদ মিয়ানমারেই তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়নি। মিয়ানমারে ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই জাপানের কিউসু অঞ্চলে আঘাত হানল ৭.০ মাত্রার বড় দুটি ভূমিকম্প। ভূপৃষ্ঠের নিচে এর উৎসস্থল ছিল মাত্র ১০.০ কিঃ মিঃ গভীরে। ফলে এই ভূমিকম্পেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে ব্যাপক। একই পরিণতি দেখা গেছে ভূপৃষ্ঠের ১৯.০ কিঃ মিঃ গভীরে অবস্থিত উৎসস্থল থেকে ৭.৮ মাত্রার ইকুয়েডর ভূমিকম্পেও। ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল মিয়ানমারে হওয়ার মানেই হলো বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় এর মাত্রা ৬.৯-এর কম। উৎসস্থলের গভীরতা, বাংলাদেশ থেকে এর দূরত্ব এবং মাটির বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করবে ঐ ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কতভাগ শক্তি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত ৬.০-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল আমাদের ভূখ-ের মধ্যে না থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দুশ্চিন্তার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। ভূ-বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ, আগ্নেয়গিরি ও মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ভূত্বক কতগুলো প্লেটে বিভক্ত। এগুলোকে বলে টেকটোনিক প্লেট। আর বাংলাদেশ অবস্থান করছে তিনটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে। এগুলো হলো ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেট। তারা আরও মনে করেন, বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থান করছে যে ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেট, সেটি প্রতি বছর ৪৫ মিলিমিটার করে ইউরেশীয় প্লেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাই যত দিন যাচ্ছে ততই বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ শুধু ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলেই অবস্থিত নয়; বরং বিশ্ব জরিপেও ঢাকা ভূমিকম্পের লিস্টে স্থান দখল করে নিয়েছে। উনিশ শ’ নিরানব্বই সালে জাতিসংঘের অধীনে রিস্ক এ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার জরিপ পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে। রজার বিল হাম তার গবেষণায় বলেছিলেন, হিমালয়ের পাদদেশে মেইন বাউন্ডারি ট্রাস্ট (এমবিটি) রয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে চার শত কিলোমিটার উত্তরে। এখানে ইউরেশীয় প্লেটের নিচে ভারতের যে প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে সেটি লক হয়ে আছে। এটি খুলে গেলেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ভূমিকম্পের কারণে তাঁর সেই আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিচ্ছে বলেই মনে হয়। দুই হাজার পাঁচ সালে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তাতে বলা হয়, আগামী দশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আট বা তারও বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হতে পারে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, এ ধরনের অন্তত সাতটি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। দুই হাজার পাঁচ সালের সাতাশ এপ্রিল ওই তারবার্তাটি পাঠান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ চামাস। কিন্তু কোন কিছুতেই যেন আমাদের টনক নড়ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বছর দেড়েক আগে একটি গবেষণা শেষ হয়েছে। সেখানে আমরা দেখিয়েছি রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে সাত দশমিক নয় মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানীতেই আড়াই লাখ লোক মারা যেতে পারে। চার শতাধিক ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। নেপালে যেটা ঘটেছে আমাদের অবস্থা হতে পারে তার চেয়েও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুনতাজ আহমেদ নূরের মতে, বাংলাদেশ খুব নাজুক অবস্থানে রয়েছে। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামও রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মাকসুদ কামাল জানান, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ। ভূমিকম্প সাধারণত সংঘটিত হয় ভূতাত্ত্বিক প্লেট বাউন্ডারি কিংবা ফাটলরেখা বরাবর। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে ভারত ও বার্মিজ খণ্ডিত প্লেটের বাউন্ডারি এবং দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করার মতো রয়েছে তিনটি ফাটলরেখা। দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ মধুপুর ফাটলরেখা। ভারতের উত্তর-পূর্ব মেঘালয় অঞ্চল ও বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছে প্রায় দুই শত ত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফাটলরেখা। আবার দেশের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর রয়েছে প্রায় এক হাজার ছয় শত কিলোমিটার লম্বা পূর্বাঞ্চলীয় সুদীর্ঘ ফাটলরেখা, যা আন্দামান নিকোবর থেকে শুরু করে হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। গত এক শত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে সাতটি বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে দুটির কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এর পরও দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ব্যাপারে চোখে পড়ার মতো কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বিধায় দেশের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আমাদের মনে রাখা রাখা দরকারÑ উনিশ শ’ আঠারো সালের আট জুলাই ৭.৬ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। আর আঠারো শ’ পঁচাশি সালের চৌদ্দ জুলাই একই মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার কেন্দ্র ছিল মানিকগঞ্জে। আরও কয়েকটি ভূমিকম্প বাংলাদেশের কেন্দ্রে না হলেও রেখে গেছে ধ্বংসের চিহ্ন। এগুলোও আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। দুই হাজার বারো সালের আঠারো সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কেঁপে উঠেছিল পুরো দেশ। প্রায় দুই মিনিট ধরে এই কম্পনে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন স্থানে কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। অনেক পাকা বহুতল ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। মানুষের মন থেকে এসব আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই হয়ে গেল আরও একটি ভূমিকম্প। সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ তীব্রতার ভূমিকম্প। এটিই শেষ কথা নয়। সামনে অপেক্ষা করছে আট বা এর বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প। তাও আবার একটি-দুটি নয়, অন্তত সাতটি এ ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশে। আতঙ্কজনক তথ্য হলোÑ রাজধানী ঢাকার ৬৫ শতাংশ এলাকা ভবন নির্মাণের উপযোগী নয়। তারপরও ঝুঁকি নিয়েই সেসব এলাকায় বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজধানীর নদী, খাল-বিল, পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করার কারণে রামপুরা, বেগুনবাড়ী খালের আশপাশ, পাগলা খালের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ এলাকা, আদাবর, বসুন্ধরা, বনশ্রী, শ্যামলী ও তুরাগ নদ সংলগ্ন এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এসব এলাকার মাটি তুলনামূলকভাবে নরম। তবে শক্ত মাটিতে ভূমিকম্প কম অনুভূত হয়। ঢাকার কতটি ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ তার নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই সরকারের কাছে। এ সংখ্যা অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। সত্তর হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ মকসুদ কামালের মতে, এটি আসলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ কোন তালিকাও তৈরি করা হয়নি। তবে এই উদাসীনতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে দেশের জনগণের চিন্তা মাথায় রেখে এখনই এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার সময়। তা না হলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব কি না সন্দেহ আছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানসম্মতভাবে মাটির গুণাগুণ যাচাই ও পাইলিং না করা, বিল্ডিংকোড অনুসরণ ও ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি না করা এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করার কারণে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও নেমে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। সরকারী তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় সাত থেকে সাত দশমিক মাত্রার ভূমিকম্প হলে নব্বই হাজার মানুষ হতাহত হবে। আর দিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে সত্তর হাজারের মতো। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার তিন লাখ ছাব্বিশ হাজার ভবনের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় বাহাত্তর হাজার ভবন সম্পূর্ণ মাটিতে মিশে যাবে এবং পঁচাশি হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙ্গার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের বিশটি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। তাই ভূমিকম্পের এই মারাত্মক আঘাত হতে দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলকে সচেতন করতে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
×