ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচ্ছিন্ন নয়, দীর্ঘ ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২১ এপ্রিল ২০১৬

বিচ্ছিন্ন নয়, দীর্ঘ ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র -স্বদেশ রায়

সজীব ওয়াজেদ জয় অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা মামলার বাংলাদেশের অংশের তদন্তের কার্যক্রম চলছে। যতদূর জানা গেছে, সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে। তার ভিত্তিতেই মামলা চলছে। আইন এই মামলাকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই সরকার যাবে। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায়, এ মামলা যতই অগ্রসর হবে ততই এর আরও তথ্য বের হবে। কারণ, মামলাটি অসত্য বলার কোন উপায় নেই- যেহেতু জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার এই ষড়যন্ত্রে আমেরিকায় যে অংশ জড়িত ছিল তাদের ইতোমধ্যে সাজা হয়েছে। তাই অপহরণ চক্রান্তটি সত্য। তাছাড়া এফবিআইও বাংলাদেশকে তথ্য দিয়েছে। এ চক্রান্তে বাংলাদেশের অংশে কতজন জড়িত ছিল এবং তারা কে কে সেগুলো বের করা ও পুরো চক্রান্ত উদ্ঘাটন ও বাংলাদেশী অংশের চক্রান্তকারীদের সাজা দেয়ার লক্ষ্যেই এখন মামলা এগিয়ে চলবে। তদন্তাধীন এ মামলা নিয়ে বেশি কিছু লেখার নেই। সাধারণত এ ধরনের মামলা হলে তার বিরুদ্ধে একটা অপপ্রচার হয় যে- মামলাটি সত্য নয়, হয়রানিমূলক। এ মামলার ক্ষেত্রে তা বলার বিবেচক লোকের কোন সুযোগ নেই। কারণ, এই কাজের এক অংশের জন্য দায়ীরা ইতোমধ্যে আমেরিকার কোর্টে শনাক্ত হয়ে সাজা পেয়েছেন। তাই এখন শুধু বলা যায়, দেশের তদন্তকারী সংস্থা যে তথ্য ইতোমধ্যে আমেরিকার কাছ থেকে পেয়েছে, ইতোমধ্যে নিজেরা খুঁজেও যে তথ্য পেয়েছে- এর পরেও যেন তারা আরও তথ্য খোঁজেন। কারণ, বিষয়টির গভীরতা নিয়ে নিশ্চয়ই দু-একজন অর্বাচীন ছাড়া কারও কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। বিষয়টির গভীরতা অনেক। জয় একজন ব্যক্তি। তিনি সরকারেরও কেউ নন। তারপরেও তাঁর এ অপহরণ ও হত্যা চেষ্টাকে কোনমতেই কোন ব্যক্তির বিষয় বলে দেখার সুযোগ নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত। কারণ, জয়কে হত্যা বা অপহরণের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনাকে অপসারণ করার একটা চেষ্টা বা চক্রান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্যও তাদের তাই ছিল। শেখ হাসিনাকে সরানোর অর্থই কিন্তু এখন বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়া। গণতন্ত্র তো থাকবেই না। অনেকে বলতে পারেন, একজন ব্যক্তিকে এভাবে রাষ্ট্রের সমতুল্য করা এক ধরনের ব্যক্তিপূজা বা স্তুতি গাওয়া- এটা সাংবাদিকতা নয়। তাদের প্রতি বিনীতভাবে বলতে চাই, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টকে ভেবে দেখুন। ব্যক্তি হত্যার ভেতর দিয়ে দেশ কোথায় গিয়েছিল? দেশ সেখানে ফিরতে পেরেছে কি? তাছাড়া বিরোধী শক্তি যখন এ ধরনের হত্যার ষড়যন্ত্রে তখন তাদের রাজনীতি কি সেটা যদি কারও বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। যাহোক, মামলাটি তদন্তাধীন, বিচার চলবে। তাই এ নিয়ে ভবিষ্যতে হয়ত আরও লিখতে হবে। তবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে এবং শেখ হাসিনা বা জয় হত্যা বা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টার চক্রান্তকে সমূলে উৎখাত করতে হলে সরকারকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। এই চক্রান্তের তদন্তের পাশাপাশি আরও অনেক চক্রান্তের তদন্ত করতে হবে। সরকার হয়ত আমাদের মতো সাধারণ সাংবাদিকের থেকে অনেক বেশি জানে। তবে তারপরেও কিন্তু বর্তমান এই ঘটনা প্রবাহে মনে হচ্ছে, এ সব বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ছবি পেতে হলে আরও কিছু ঘটনার তদন্তে যাওয়া উচিত। যেমন, ২০০১-এ মেহেরপুরে একটি ষড়যন্ত্রের বৈঠক হয়েছিল বলে অনেকেই কম বেশি জানেন। ওই বৈঠকে কারা গিয়েছিলেন? কী উদ্দেশ্য ছিল ওই বৈঠকের। লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার আগেই এ বৈঠকটি হয়। ঢাকা থেকে মেহেরপুরে কয়েকজন যান সেদিন। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে, একটি প্রগতিশীল সরকারের স্বার্থে বিষয়টির তদন্ত যে কোন সময় হওয়া উচিত বলে মনে হয়। ২০০১ এর নির্বাচনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের কি শুধু নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল না তাদের নিয়ে আরো কোন উদ্দেশ্য ছিল- সেগুলোও এখনও তদন্ত হতে পারে। লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরে বিশেষ পেশার কয়েকজনকে বার বার বঙ্গভবনে ডাকা হতো। তাদের সঙ্গে সেদিন কী বিষয় নিয়ে আলাপ হতো? ওই চক্রান্তে শেখ হাসিনা বা গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য কী কাজ সেদিন করা হয়েছে এগুলোও কিন্তু আজকের বাস্তবতায় কম প্রয়োজনীয় নয়। এ মুহূর্তের বাস্তবতায় আরও প্রয়োজন, সেদিন আওয়ামী লীগকে যে ৫৪টি আসন দেয়া হবে ওই ব্লু প্রিন্ট তৈরির কাজে কারা কারা জড়িত ছিলেন? তারা এখন কোথায় কী কাজ করছেন? ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিনিধিকে আমেরিকার কোথায় এবং কার মাধ্যমে সেদিন চার দলীয় জোট ঘুষের টাকা দেয়। সেদিনও যেমন ছিলো এখনও এসব চক্রান্তে আইএসআই এবং উলফার টাকা আছে। এমনকি বাংলাদেশে এখন অনেকেই উলফার টাকার মালিক। তারা কোথায় কী করছেন, সেগুলো তদন্ত করতে গেলে, ২০০১-এ কিভাবে হাওয়া ভবনসহ কয়েক জায়গায় উলফার টাকা পৌঁছাত- সেগুলো তদন্ত করলেও অনেক কিছু বের হবে। কারণ, ২০০১-এর বহু আগেই উলফা ও জামায়াতে ইসলামী এক হয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে ২০০১-এ যে পরিবর্তনটি হলো তা হচ্ছে, ২০০১ বাংলাদেশে উলফা ও জামায়াতে ইসলামীর এই সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে একটি এলিট শ্রেণী সরাসরি যোগ দেয়। বেগম জিয়া প্রকাশ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বললেন। কেন এগুলো ঘটলো। কেন এক শ্রেণীর এলিট যোগ দিল? কী তাদের উদ্দেশ্য? এগুলো এখন খুঁজে বের করার সময়। উল্লেখ্য, এ ধরনের একটি এলিট শ্রেণী কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরানো ও হত্যার কাজে প্রথম থেকেই জড়িত ছিল। বিষয়টি শুধু জয় অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা একবার হয়েছিল সেখানেই থেমে আছে এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই। উলফার অস্ত্র যে হারে পাওয়া গেছে ওই হারে উলফা সদস্য কিন্তু গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। উলফার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল বাংলাদেশের এমন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য যারা তামিল টাইগারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশের স্থায়ী ও বুনিয়াদি গণতন্ত্রের স্বার্থে এগুলো তদন্ত হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। সরকার যতজন উলফা সদস্য গ্রেফতার করেছিল তাদের ভেতর লোকচক্ষুর অন্তরালে কেউ জামিন পেয়েছে কিনা? পেয়ে থাকলে তারা এখন কোথায়? এ সব বিষয় সবই একই সুতোয় গাঁথা। কোনটাকেই এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। এমনকি ব্যারিস্টার রেজ্জাক ও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ছেলেরা কি শুধু নিউইয়র্কে তাদের সব সময়টুকু কাটাচ্ছে? তারা আর কী কী করছে এ বিষয়গুলো জনগণের সামনে আনা প্রয়োজন। এগুলোর ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তেমনি খোঁজ নেয়া প্রয়োজন তাদের সঙ্গে কার কার বৈঠক হচ্ছে? সে বৈঠকগুলো কি কেবলই যুদ্ধাপরাধী বাঁচানোর জন্য না আরও কোন সুদূরপ্রসারী বিষয় আছে সেখানে? কয়েক মাসের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তির সঙ্গে এদের কোন বৈঠক হয়েছে কিনা সেটাও খোঁজ নেয়া দরকার। এ সব বিষয় তদন্ত করে চক্রান্তের মূলোৎপাটন এক্ষুণি প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের জিডিপি ৭.০৫-এ পৌঁছেছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তাঁর দেশের আগামী জিডিপির কথা বলতে গিয়ে বিবিসিকে বলেছেন, জিডিপি সাতের ওপরে গেলে ডাবল ফিগারে যাওয়া দ্রুত সম্ভব। আমাদের অর্থমন্ত্রীও বহুদিন যাবৎ একই কথা বলছেন। তিনি বার বার বলে আসছিলেন, আমাদের ছয়ের বৃত্ত ভাঙ্গা দরকার। এই বৃত্ত ভাঙলে আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। শেখ হাসিনা সে বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলেছেন। তাই ২০০১ থেকে যারা শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি নাজুক পরিস্থিতির দেশে পরিণত করতে চাচ্ছেন, তাদের এখন শেষ আঘাত হানার সময়। কারণ তারা জানে এর পরে আর তারা শেখ হাসিনার ডানা স্পর্শ করতে পারবে না। তাই এখন তারা সকলেই উলঙ্গ হয়ে নামবে। এরা কোন রাখঢাকও করবে না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ২০১৬’র একটি ঘটনা নিয়ে লিখতে গিয়ে কেন ২০০১কে একটি ভিত্তি বছরের মতো ধরা হলো? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে। তবে বিষয়টি খুবই স্বচ্ছ। কারণ, ২০০১ ছিল শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার বছর। ১৯৯৬ তে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্ট থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এই প্রগতিশীল শক্তিকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে দেশের এই অশুভ শক্তি সক্ষম হয়। ১৯৯৬ তে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তারা মনে করেছিল শেখ হাসিনা ব্যর্থ হবেন। তাঁর সরকারের আয়ু বঙ্গবন্ধু সরকারের মতো অতি অল্প সময়ের জন্য হবে। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করে শেখ হাসিনা যখন একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের চরিত্র প্রকাশ করলেন তখন তারা ২০০১-এ শেখ হাসিনা বিনাশের কর্মসূচী নেয়। ২০০১-এর ‘সালসা’ নির্বাচন চক্রান্ত দিয়েও শেষ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে। ২১ আগস্ট করেও ব্যর্থ হয়। বার বার ব্যর্থ হয়ে এখন জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা পর্যন্ত চলে গেছে। আরও বহুদূর তারা যাবার চেষ্টা করবে। তাই এই চক্রান্তের পূর্ণ ছবি পেতে হলে ২০০১ থেকে ২০১৬ অবধি সীমানা ধরে এ মুহূর্তে এগোতে হবে। [email protected]
×