ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোহিনুর তুমি কার?

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২১ এপ্রিল ২০১৬

কোহিনুর তুমি কার?

নতুন করে দেখা দিয়েছে ভুবনবিখ্যাত হীরক খ- কোহিনুর বিতর্ক। নতুন প্রজন্মের ব্রিটিশ রাজদম্পতি প্রিন্স উইলিয়াম ও কেটের সাম্প্রতিক ভারত ও ভুটান সফর এতে যুগিয়েছে বাড়তি ইন্ধন। কোহিনুর শব্দটি ফারসি, বঙ্গার্থ দাঁড়ায় আলোর পাহাড় বা পর্বত। ত্রয়োদশ শতকে এই মহামূল্যবান রতœটি অন্ধ্র প্রদেশের গন্টুর খনি থেকে তোলা হয়েছিল। আনকাট অবস্থায় এর ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। তৎকালে এটি ছিল তাবৎ বিশ্বের সর্ববৃহৎ হীরকখ-। কালে কালে বার বার হাতবদল ও কাটাকাটির পর এর সর্বশেষ ওজন দাঁড়ায় ১০৫ ক্যারেট। তাই বলে বিশ্বের এবং ভারতেরও স্বচ্ছতম ও সুন্দরতম এই অমূল্য রতœটির আলোর অভাব হয়নি কখনও। আর তাই এটি নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারিও কিন্তু কম হয়নি ইতিহাসে। অবশ্য এরকম অভিশপ্ত রক্তক্ষয়ী ইতিহাস বোধকরি সব অমূল্য রতেœর পেছনেই লুকায়িত থাকে। কোহিনুর তার ব্যতিক্রম হবে কেন? হীরক খ-টি দিল্লীর খিলজী ও মোগল শাসকদের হাতে চলে যায়। সম্রাট শাহজাহান এই হীরকটি স্থাপন করেন তার বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনে। পরে পারস্যের শাসক দিল্লী আক্রমণ করে কোহিনুর খচিত ময়ূর সিংহাসন লুট করে নিয়ে যান পারস্যে। ইরান বা পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কোহিনূর হস্তগত হয় আফগান শাসকদের। তাদের কাছ থেকে এটি অধিকার করেন পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটি হস্তগত করে পাঠিয়ে দেয় ব্রিটেনে। সেখানে কোহিনুর রানী ভিক্টোরিয়ার মুকুটে খচিত হয়ে নিয়ত শোভাবর্ধন করতে থাকে এবং মাঝেমধ্যে স্থান পায় টাওয়ার অব লন্ডনে প্রদর্শনীর নিমিত্তে। এই নিয়েই মামলা। কোহিনুর, টিপু সুলতানের তরবারি, আংটিসহ প্রাচীন অমূল্য রতœ ও সম্পদ যুক্তরাজ্য তথা ব্রিটেন থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনার দাবিতে ভারতীয় আদালতে মামলা করে অল ইন্ডিয়া হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিস ফ্রন্ট। সুপ্রীমকোর্ট এই ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাব জানতে চাইলে সলিসিটর জেনারেল সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানান, ইংরেজ শাসকরা কোহিনুর চুরি করেনি, লুট করেও নিয়ে যায়নি, বরং পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের পুত্র দুলীপ সিং ১৮৪৯ সালে স্বেচ্ছায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই অমূল্য সম্পদ। তবে সর্বোচ্চ আদালত তাতে সায় দেয়নি। বরং সুপ্রীমকোর্ট ভারত সরকারকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দেয়ার জন্য ছয় সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছেন। সাবধান করে দিয়ে আদালত বলেছেন ভেবে চিন্তে মতামত দিতে। কেননা, তাহলে ভবিষ্যতে আর কোন দাবি জানানোর উপায় থাকবে না সরকারের। তিন বছর আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দিল্লী সফরকালে কোহিনুর ভারতকে ফেরত দেয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, এটি যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে। ভারত ছাড়াও কোহিনুরের আরেক দাবিদার পাকিস্তান। বাংলাদেশই বা কেন নয়? প্রকৃতপক্ষে কোহিনুরসহ সকল ইতিহাস-ঐতিহ্যের মহামূল্যবান সম্পদই এই অখ- উপমহাদেশের অংশ এবং সেই কারণে দাবিদারও। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই উপমহাদেশকে শাসন-লুণ্ঠন-শোষণ করেই ব্রিটেনের যা কিছু সানশওকত ও সাম্রাজ্যবাদী সমৃদ্ধি। আঠারো শতকের শুরুতে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ২৩ শতাংশ ছিল ভারতবর্ষের। তখন এটা ছিল সর্বত্র ইউরোপের অর্থনীতির স্থান। ২০০ বছর ধরে ভারতবর্ষকে লুণ্ঠনের মাধ্যমেই ব্রিটিশ অর্থনীতি পৌঁছায় উৎকর্ষের শিখরে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের অর্থনীতি এক পর্যায়ে নেমে আসে মাত্র ৪ শতাংশে। উনিশ শতকের শেষে উপমহাদেশ ছিল ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ অর্থ-সম্ভারের ভা-ার। এখন তার সেই ঋণ পরিশোধের পালা। নতুন প্রজন্মকে ভাবাবেগ বিবর্জিত হয়ে হিসাব করতে হবে দেনা-পাওনার। আর এক্ষেত্রে শুধু কোহিনুর কেন, টিপু সুলতানের তরবারিসহ অমূল্য সম্পদরাজি ফেরত এবং অতীতের অব্যাহত অত্যাচার-লুণ্ঠনের জন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও উঠতে পারে।
×