ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহারে কর্তাদের উদ্বেগ এবং ট্যানারির সাভার যাত্রা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৮ এপ্রিল ২০১৬

‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহারে কর্তাদের উদ্বেগ এবং ট্যানারির সাভার যাত্রা

আজকে তিনটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব। বিষয় তিনটি হচ্ছে : সমবায় সমিতি কর্তৃক ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার, খাদ্য দূষণ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং তৃতীয়টি হচ্ছে চর্মশিল্প বিষয়ক। একটা সমস্যা সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/বিভাগ কত সময় নিতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার। বহুদিন যাবত এই ‘ব্যাংক’ শব্দটি আমাদের দেশের সমবায় সমিতিগুলো ব্যবহার করে আসছে। অথচ এই শব্দ ব্যবহার ‘ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট-১৯৯১’-এর একটা ধারা মোতাবেক নিষিদ্ধ এবং দ-নীয় অপরাধ। ১৯৯১ সাল এবং ২০১৬ সাল, ২৫ বছরের মামলা। এতদিন পর দেখলাম এই শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ। কাগজে দেখলাম অর্থ সম্পর্কিত যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের একটি সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে সমবায়গুলো ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। মজার ঘটনা- তাই না! সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ২৫ বছর সময় লাগল এটা বুঝতে যে, ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করে দেশের সমবায়গুলো জনগণকে প্রতারিত করছে। অবশ্য ইতোমধ্যে মানুষের ক্ষতি যা হবার হয়েছে। এই ক্ষতির দায়-দায়িত্ব কে নেবে- বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবায় অধিদফতর, রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ ও ফার্ম, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ), ইনসিউরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (ইডরা)? আমি নিশ্চিত পারস্পরিক দোষারোপ করে কর্মকর্তারা যার যার প্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন। মনে পড়ে ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে যখন দেশে নতুন করে বেসরকারী খাতে ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান/বিনিয়োগ কোম্পানি করার অনুমতি দেয়া হয় তখন বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো (বিসিআই/এনসিএল) দুটো বেআইনী কাজ শুরু করে। তারা ‘আমানত’ নিতে পারত না, চেকবই ব্যবহার করতে পারত না। কিন্তু ছলচাতুরির মাধ্যমে এমন সব কাগজপত্র ব্যবহার করা শুরু করে যা কার্যত ‘চেকবই’ই। আমানতও তারা নিতে শুরু করে। চেকবই ব্যবহারের মাধ্যমে যে টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হয় তাই আইনত ‘আমানত’ (ডিপোজিট)। কী করল এই বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো? বিজ্ঞাপন দিল, বিলবোর্ড করল এবং লিখল : ‘ব্যাংক উইথ আস।’ সরাসরি নিজেদের তারা ব্যাংক বলে দাবি করল না; কিন্তু ব্যাংক শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিল তারা ব্যাংক। পরিণাম? তখনকার সময়ে একটি বিনিয়োগ কোম্পানিই ১৯০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে বসল। কোন বিচার-আচার হয়েছে? না, এমন কথা শুনিনি। শত হোক সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ নানা ‘দ্বীপের বন্ধু’। শেষ পর্যন্ত সরকার ঐ খোঁড়া প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক বানিয়ে দেয়। এটাই এখন ‘বাংলাদেশ’ কমার্স ব্যাংক লিঃ’। কী আর বলব? সরকারের বিভিন্ন বিভাগ/প্রতিষ্ঠান, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এভাবে চলে। সর্বশেষ উদাহরণ ‘ব্যাংক’ শব্দ নিষিদ্ধকরণ। নিষিদ্ধকরণ নতুনভাবে হবে কেন? ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট-১৯৯১-এর ৮ ধারায় পরিষ্কারভাবে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা আছে। এতে বলা আছে কোন্্ কোন্্ ক্ষেত্রে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে। যাক শেষ পর্যন্ত যার কল্যাণেই হোক এই ধরনের জালিয়াতি বন্ধের ব্যবস্থা হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ধন্যবাদ জানাই। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দুটো পৃথক সমাবেশে খাদ্যদ্রব্য এবং খাদ্যমূল্য নিয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, সামনে রমজান মাস। চাল, ডাল, নুন, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, সয়াবিন ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ আছে। অতএব ব্যবসায়ীদের ঘাটতিজনিত কারণে মূল্যবৃদ্ধির কোন কারণ নেই। তিনি আরও বলেছেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। এদিকে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২০১ জন ‘ফুড ইন্সপেক্টর’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং সকল জেলায় ‘সেইফ ফুড কোর্ট’ স্থাপন করা হয়েছে। দশটি ল্যাবরেটরিও এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দুই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রথমত সরকার রোজার মাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। দ্বিতীয়ত খাদ্যে ভেজাল বন্ধেও সরকার আন্তরিক। এই সম্পর্কে বেশি কিছু বলার নেই। তবে স্মরণীয়, গেল বছর রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের বাজার বেশ স্থিতিশীল ছিল। কোন বড় ধরনের অভিযোগ কোথাও উঠেনি। এই ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন। তবে এ বছর ‘ঢিলা’ দিলে চলবে না। গেল বছর ব্যবসায়ীরা সুযোগ পায়নি, এবার তাই তারা সুযোগ খুঁজতে পারে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের একাংশ কিন্তু কারও কথায় বা উপদেশে চলে না। তারা নিজের পকেট ছাড়া আর কিছুই চেনে না। অতএব সাবধানের মার নেই। প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কত, রোজার মাসে চাহিদা বেড়ে কত হয় তা সংশ্লিষ্ট বিভাগ/সংস্থার জানার কথা। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার এক নম্বর শর্ত হলো জোগান, চাহিদানুযায়ী জোগান। প্রতিটি পণ্য প্রয়োজনমতো বাজারে যাতে থাকে তার প্রস্তুতি রাখা একান্ত জরুরী। সরবরাহ ঠিক থাকলে ব্যবসায়ীরা কোন সুযোগ নিতে পারবে না। বড় বড় শহরের প্রধান প্রধান সড়কে ‘ওপেন সেলের’ ব্যবস্থা অগ্রিম ভিত্তিতে চিন্তা করে রাখতে হবে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করতে হবে। ইতোমধ্যেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। কোন্্ অবস্থায় সঙ্কট তৈরি হয়, কোথায় কোথায় পণ্যের চাহিদা কী রকম হয় তার খোঁজ-খবর আগেই নিয়ে রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, দ্রব্যমূল্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এমনকি ব্যবসায়ীদের আশ্বাসও এক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে না। মন্ত্রী মহোদয় বাজারে গেলে টিভি ক্যামেরার সামনে ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক মূল্যই দেখাবেন। এসব প্রতিবছর দেখে আসছি। বাণিজ্যমন্ত্রী অভিজ্ঞ লোক। আশা করি প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের ওপর নির্ভর না করে পণ্যের জোগানের ওপর ভরসা রাখবেন তিনি। রমজানের এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। আশার কথা, সরকার আগেভাগে এ বিষয়ে ভাবছে। খাদ্য দূষণের কথা বলা জরুরী। এ বিষয়টি মানুষের বাঁচা-মরার সঙ্গে সম্পর্কিত। অতএব সর্বাধিক গুরুত্ব এক্ষেত্রে দিতে হবে। খাদ্যপণ্য দূষণের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। আশার কথা, সরকার এক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা বাস্তবায়নের। ‘সেইফ ফুড কোর্ট’ সব জেলায় স্থাপিত হয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। এগুলো যাতে কার্যকরভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা দরকার। ল্যাবরেটরিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ যাতে বিনা বাধায় করতে পারে তার নিশ্চয়তাও দরকার। জনমনে খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে আশঙ্কা কিন্তু সর্বব্যাপী। মানুষ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, তারা নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করছে। অসুখ-বিসুখ বাড়ছে। কিছুদিন আগে ‘কিডনি’ রোগের ওপর একটা স্টোরি পড়ছিলাম। ডাক্তার সাহেবরা ‘বিষযুক্ত খাবার’কে বহুলাংশে দায়ী করলেন এবং বললেন, এই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করছে। কিডনি রোগের প্রসার দেখে বেসরকারী হাসপাতালগুলো তাদের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করছে। এমতাবস্থায় ‘বিষযুক্ত’ দূষিত খাদ্য যাতে বাজারে বিক্রি হতে না পারে তার ব্যবস্থা দরকার। প্রয়োজনে বাজারে বাজারে ‘আচমকা’ অভিযান দরকার। মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। হাইব্রিড শাকসবজি ইত্যাদি সম্পর্কেও সচেতন হওয়া দরকার। মৎস্যখাদ্য (ফিড) সম্পর্কে নানা কথা বাজারে চালু। এসব আমলে নেয়া দরকার এবং জরুরীভিত্তিতে করণীয় ঠিক করা দরকার। তৃতীয় বিষয়টি নদী দূষণ, বায়ু দূষণ সম্পর্কিত। ঢাকা শহর এবং বুড়িগঙ্গা নদীর শত্রু ট্যানারি শিল্প সম্পর্কে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু আপোসহীন একটা ‘স্ট্যান্ড’ নিয়েছেন। কিন্তু বুঝতে পারছি না মন্ত্রী বড়, না তার অধস্তন কর্মকর্তা বড়। হিসেবের কথায় মন্ত্রী বড়, অধস্তন কর্মকর্তা অনেক নিচে। কিন্তু একই দিনের (সোমাবার) দুটো খবরে তো মানুষের মনে সন্দেহ : কে বড়? মন্ত্রী বলেছেন, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে, গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর জন্য বুড়িগঙ্গাকে মরতে দিতে তিনি পারেন না। লাখ লাখ লোককে তিনি বিপদে ফেলতে পারেন না। অতএব তিনি বাধ্য হয়ে কাঁচা চামড়া হাজারীবাগে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছেন। বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের কোন হেরফের হবে না। এই খবর পড়ার পরেই দেখি এক কর্পোরেশনের প্রধান বলেছেন, আরও সাতদিন সময় দেয়া হলো। এটা কী? এসব হলে তো মন্ত্রীদের কোন মর্যাদা থাকে না। সরকারী সিদ্ধান্তের ওপর মানুষের আস্থাও হ্রাস পায়। তাই নয় কি? না কি পুরো বিষয়টিই সমঝোতার? লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×