ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বলো তারে শান্তি শান্তি

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ৪ এপ্রিল ২০১৬

বলো তারে শান্তি শান্তি

‘শান্তি’ শব্দটি পরম সুখের হয়ে দাঁড়ায় যখন হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, সংঘাত, সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। সমাজ জীবনে শান্তি ও স্বস্তির বিকাশ ঘটে মানবজীবনে তার অস্তিত্ব বহাল তবিয়তে বজায় থাকার ওপর। শান্তির সন্ধানে মানুষের নিরন্তর যাত্রা। একটু শান্তিতে থাকতে চাওয়ার মধ্যে প্রাণের আকুলতাই ঝরে পড়ে। কিন্তু এই ‘শান্তি’ শব্দটাই যে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তার জাজ্বল্য নমুনা এবং প্রমাণ বলা যায় একাত্তরের ‘শান্তি কমিটি’। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশে বাঙালী নিধনে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে বিপর্যস্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বাঙালী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী মানসজাত নরাধমরা গড়ে তুলেছিল শান্তি কমিটি। পঁচিশে মার্চের গণহত্যার ১৫ দিনের মাথায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার পাশবিক প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা দানের উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো বাঙালী বিদ্বেষকে সার্থকতা দানে সংঘবদ্ধ হয়েছিল এ কমিটির মাধ্যমে। অথচ তখনও স্বাধীন বাংলার সরকার ঘোষিত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে ওঠেনি। বিচ্ছিন্নভাবে লড়াই করেছে তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে। এ শান্তি কমিটিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী বাঙালী নিধন অভিযান শুরুর পর জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য খোলাখুলিভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। জামায়াতের সঙ্গে তখন জোট বাঁধে উভয় গ্রুপের মুসলীম লীগ, নেজামী ইসলামী, জমীয়তুল ইসলামী, পিডিপি, কৃষক শ্রমিক পার্টিসহ আরও কয়েকটি বাঙালী বিদ্বেষী পাকিস্তানীমনা দল ও গোষ্ঠী। এরা সত্তরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরেছিল। অধিকাংশেরই জামানত বাজেয়াফত হয়েছে। ২৫ মার্চ তাদের কাছে শোকাবহ হয়ে ওঠেনি। শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় হতেই এরা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। শেখ মুজিবের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বিপরীতে এরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য জান্তাদের পদলেহনে নিয়োজিত হয়ে পড়ে গোপনে। অপারেশন সার্চলাইটের আগে ‘রেকি’ দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তারা এবং স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকাটা তারাই সরবরাহ করেছিল। তাদের পরামর্শেই পাকি জান্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বেছে বেছে শিক্ষকদের বাসভবনে হামলাসহ গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চের পর সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো প্রকাশ্যে নামে। একাত্তরের ৪ এপ্রিল পিডিপি নেতা নুরুল আমীনের নেতৃত্বে প্রথম সুযোগেই কসাই জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে গোলাম আযম অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বৈঠক শেষে তাদের উৎফুল্ল হাসি হাসি মুখের ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। এর দু’দিন পর ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আলাদাভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনের তালিকা তিনি সাক্ষাতকালে টিক্কার হাতে দিয়েছিলেন কিনাÑ সে তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়নি। টিক্কার সঙ্গে বৈঠকে দালালের শিরোমণি গোলাম আযম বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলÑ ‘ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাত করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্রবাহিনীকে সাহায্য করবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল ১৯৭১)। বিস্ময়কর যে, তখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দানের অবস্থা তৈরি হয়নি। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমপিরা সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়নি। যদিও ২৬ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা হয়েছিল। ভারত বিরোধিতার নামে ২৫ মার্চের পরপরই আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর আগে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় জামায়াত। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর কার্যকরী পরিষদ মজলিসে আমেনার বৈঠকে সে সময় কোন প্রসঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও ভারতকে টেনে আনা হয়। দৃশ্যপটে তখন ভারতের অবস্থান না থাকলেও বলা হয়Ñ ‘ভারতের মতো বৈরী ভাবাপন্ন একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মোকাবেলায় ফেডারেল পদ্ধতির অধীনে প্রতিটি অঞ্চলকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে।’ পাকিস্তান রক্ষার জন্য জামায়াত সত্তরের নির্বাচনের পরই ওঠে পড়ে লাগে। গোলাম আযম ১৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে যে, নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা ও অসদুপায় সত্ত্বেও জনগণের রায় সুষ্পষ্ট। জনগণ গণতান্ত্রিক পন্থায় শেখ মুজিবের প্রতি যে আস্থা প্রকাশ করেছেন, তাতে গোলাম আযম শ্রদ্ধা পোষণ করে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করে। জামায়াতী নেতা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ‘দেশের সংঘবদ্ধ এক বিশেষ চক্রের’ বিরুদ্ধে সর্তক থাকার আবেদন জানিয়ে বলেÑ ‘এরা যে কোন মুহূর্তে অগণতান্ত্রিক পন্থার আশ্রয় নিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হতে পারে।’ তার এ বক্তব্যের সংঘবদ্ধ চক্র যে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা; তা স্পষ্ট হলেও আড়ালে অন্যকোন ইঙ্গিত রয়েছে কিনাÑ তা সে সময়ে স্পষ্ট হয়নি। এই গোলাম আযমই জনগণের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ২৫ মার্চের পরপরই পাকিস্তানী জান্তাদের দ্রুত সহযোগীতে পরিণত হয় প্রকাশ্যেই। পাকিস্তানীদের গণহত্যাকে সে প্রকারান্তরে সমর্থন করে পাকিস্তানের সংহতির পক্ষাবলম্বন করেছিল। ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারার’ রাজনীতিতে অভ্যস্ত গোলাম আযমরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়। একাত্তরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালীরা কলঙ্কজনক ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়। সকালে টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে ‘শান্তি কমিটি’র ঘোষণা দেয়া হয়। গোলাম আযমের তৎপরতায় গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হয় কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা ও সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত খাজা খয়েরুদ্দিন। তিন নম্বর সদস্য হয় গোলাম আযম। ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঢাকার একটি আসনে অংশ নিয়ে গোলাম আযম মাত্র ৩৫ হাজার ৫শ’ ২৭টি ভোট পেয়ে হারে। আওয়ামী লীগের এ্যাডভোকেট জহিরউদ্দিন ১ লাখ ১৬ হাজার ২শ’ ৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। সেই গোলাম আযমরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণার আগেই পাকিস্তান রক্ষা ও বাঙালী নিধনে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। সারাদেশে জামায়াত, মুসলীম লীগ নেতাকর্মীরা বাঙালীবিরোধী ও পাকিস্তানের পক্ষে এক কাতারে নেমে আসে। শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠকে ‘ভারতীয় ও অন্যান্য ইসলামবিরোধীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়োচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায়’ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকের এক প্রস্তাবে ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক, আইনজীবী, মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার মোদাররেসদের প্রতি জনসাধারণকে কোরান ও সুন্নাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তোলার আহ্বান জানানো হয়। যাতে জনসাধারণ ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মোকাবেলা করতে পারেন এবং প্রয়োজন হলে জিহাদে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন’ (২৩ এপ্রিল ১৯৭১, দৈনিক পাকিস্তান)। গোলাম আযমদের এই কথিত শান্তি কমিটি ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সকল দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানীর প্রতি রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে সবরকমভাবে সশস্ত্রবাহিনীকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছিল (২৩ এপ্রিল ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)। ১০ এপ্রিল সকালে যখন ঢাকায় শান্তি কমিটি ঘোষিত হয় তখন মুক্তাঞ্চলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামত অনুযায়ী প্রবাসী সরকার গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। সন্ধ্যায় ঘোষিত হয় সরকার আকাশবাণীর মাধ্যমে। এর ৭ দিন পর ১৭ এপ্রিল সরকার শপথ নেয় মুজিবনগরে। এ সরকার গঠনের আগেই গোলাম আযমরা সংগঠিত হয় বাঙালীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গঠনে। এপ্রিলেই যুদ্ধরত বাংলাদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি তার স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায়েও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিটি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দখল করে। আইয়ুব আমলের বুনিয়াদী গণতন্ত্রে নির্বাচিত বা মনোনীত মুসলীম লীগের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা এ কমিটির নেতৃত্বে আসীন হয়। নূরুল আমীনের পিডিপিও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতৃত্ব নেয়। এ শান্তি কমিটির সদস্যরা সেনা ক্যাম্পগুলোতে আসা-যাওয়া করত। স্বাধীনতাকামীদের তালিকা প্রদান করার কাজটি শুধু নয়, পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে গ্রামে গ্রামে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। মানুষের গরু-খাসিসহ অর্থ-সম্পদ লুট করত। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত। নারী নির্যাতনেও সহায়তা করত। কেউ কেউ সেনা ক্যাম্পে মেয়েদের পৌঁছে দিত। নিরীহ যুবকদের ধরে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে হত্যা করাতে পিছপা হতো না। অনেক অঞ্চলে এ শান্তি কমিটির নেতারা হিন্দুদের হুমকি দিত গয়না-ঘাঁটি, টাকা-পয়সা না দিলে মেরে ফেলার। যারা ভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিত তাদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি লুট করে নিত। আবার মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারগুলোকে হুমকি দেয়া হতো, অর্থকড়ি না দিলে তাদের সন্তানদের সেনাদের হাতে তুলে দেবে। শান্তি কমিটির সদস্যরা অর্থে-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। পাকিস্তান রক্ষায় তাদের এ নারকীয় ভূমিকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট করত। জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সহযোগিতার জন্য কসাই টিক্কা খানের মতো নরাধম খুনীও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো। জুলাই মাসে রাজশাহীতে সফরে যায় টিক্কা খান। শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয় ‘সারা রাজশাহী বিভাগে গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের নির্মূল করা হয়েছে।’ জবাবে টিক্কা খানও জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের ‘উত্তম’ কাজের প্রশংসা করেন। টিক্কা খান ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের’ উপস্থিতির কথা সেনা কর্তৃপক্ষকে জানাবার জন্য তাদের নির্দেশ দেন, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে (৬ জুলাই ১৯৭১, দৈনিক পাকিস্তান)। রংপুরে টিক্কা খান ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের’ নির্মূল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কাজে সহায়তা করার জন্য শান্তি কমিটি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; তার প্রশংসা করে বলেন, ‘তারা প্রদেশের সর্বত্র শান্তি বজায় রাখা এবং জনগণের আস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ১২ আগস্ট দৈনিক পাকিস্তান আরও উল্লেখ করে যে, দিনাজপুরে শান্তি কমিটির সভাপতি টিক্কা খানকে জানায়, সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া গেছে। সিলেট অঞ্চলে উপজাতি তথা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অনেক শিক্ষিতজনরাও শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে কথিত ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের’ নির্মূলে তৎপর ছিল। পাকিস্তানীরা শান্তি কমিটির মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতাও চালিয়েছে। ১৬ আগস্টের দৈনিক পাকিস্তানে লেখা হয়েছেÑ ‘সেনাবাহিনী ও শান্তি কমিটির মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শান্তি কমিটি যদি দুনিয়াকে জানিয়ে না দিত যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশকে অখ- রাখতে চায়, তবে পরিস্থিতি হয়ত অন্যদিকে মোড় নিত। দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। তাই দেশের মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব শান্তি কমিটির হাতে তুলে নিতে হবে।’ এছাড়া ঘরে ঘরে যেসব ‘দুশমন’ রয়েছে তাদের খুঁজে বের করার ওপরও গুরুত্বারোপ করে গোলাম আযম। দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশ করে গোলাম আযম বলেছিল, ‘পাকিস্তান ঠিক থাকলে আজ হোক কাল হোক বাঙালী মুসলমানদের হক আদায় হবে। কিন্তু আজাদী ধ্বংস হলে মুসলমানদের শৃগাল-কুকুরদের মতো মরতে হবে।’ গোলামরা একাত্তরেই বাঙালীদের শৃগাল-কুকুরের মতো হত্যা এবং তাদের খাদ্যে পরিণত করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নির্বাহী সদস্য আবদুল খালেক ২৫ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে নির্র্মূল হয়েছে। ১৮ আগস্ট লাহোরে গোলাম আযম জামায়াতের কেন্দ্রীয় বৈঠকে বলেছিলÑ ‘ভারত দুষ্কৃতকারীদের সাহায্য করছে, তাই পাকিস্তানের উচিত কালবিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।’ গোলাম আযম হায়দরাবাদে ৩১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানালে খানসেনারা তা মেনে নেয়। শান্তি কমিটির অধিকাংশ নেতা জান্তাদের উপনির্বাচনে অংশ নেয়। কোন ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। ৮৮ আসন জামায়াতসহ অন্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। এমনকি গবর্নর ডাঃ মালেকের ১০ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদে জামায়াতী ২ জন সদস্য ছিল। গোলাম আযম নিজেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বিবৃতিতে উল্লেখ করে যে, খাঁটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। এ পরিবেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা আমার দেশ শাসিত হোক, তা দেখার জন্য আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হতে পারেনি। একাত্তরের শান্তি কমিটির অনেক নেতারই বিচার হয়েছে স্বাধীনতার পর দালাল আইনে। অনেকেরই শাস্তি হয়। অধিকাংশ পালিয়ে গিয়েছিল। সেই শান্তি কমিটির সদস্যরা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আবার স্ব-ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। এদের অনেকে রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও আসীন। তাই তারা মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে হেনস্তা করার জন্য নানা রকম ছলচাতুরিরও আশ্রয় নেয়। এরা গর্বের সঙ্গে বলেও বেড়ায়Ñ একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম। শান্তি কমিটির পক্ষে এভাবে কথা বলা মূলত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। একাত্তরের এই নরকের কীটরা কিলবিল করে আজও। তাদের বহাল রেখে কবির ভাষায়Ñ ‘বলো তারে শান্তি শান্তি’ উচ্চারণ করা দুরূহ। একাত্তরের শান্তি কমিটির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে সবার স্বরূপই উন্মোচিত হবে। তাই যেন হয়।
×