ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

হার্ট এ্যাটাকে মহিলার মৃত্যু ॥ পুলিশ মোতায়েন

মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৮ মার্চ ২০১৬

মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারের সূত্র ধরে রাজধানীর মোহাম্মপুর আটকে পড়া পাকিস্তানীদের জেনেভা ক্যাম্পে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে চৌদ্দ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে হার্টএ্যাটাকে এক বয়স্ক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। সংঘর্ষকালে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, দোকানপাট, বাড়িঘর, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার রাত নয়টায় মোহাম্মদপুর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মার্কেট ক্যাম্পে ঘটনার সূত্রপাত। দুই নারী মাদক সম্রাজ্ঞী সীমা আর পারুলের মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারের সূত্র ধরে সংঘর্ষ শুরু হয়। চলে বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত। স্থানীয়রা জানান, সীমা জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ইয়াবা সম্রাজ্ঞী। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, আফিম, চরস, ভাং ও ফেনসিডিলের পাইকারি বিক্রেতা। তার নিজস্ব বিক্রেতা রয়েছে। তাদের মাধ্যমে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করে থাকে। পুরো ক্যাম্পেই বহুকাল ধরে মাদক বিক্রি করে আসছে। তার দাপটে কিছুই বলা যায় না। কেউ কিছু বললেই তার শান্তি কমিটির লোকজন ছেলে মেয়ে মানে না, যাকে বাসায় পায়, তাকেই ধরে নিয়ে মারধর করে। অনেককে বাড়িঘর পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে। অনেকেই তাদের হাতে মার খেয়ে রীতিমতো পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাদের হাত থেকে মহিলারাও রক্ষা পায় না। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী এসব মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে। ১৫ বছরের ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে ৪০-৪৫ বছর বয়স্ক মানুষ রয়েছে তার দলে। শুধু ইয়াবা ব্যবসা নয়, নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গেও যুক্ত সে। বহুকাল ধরে এ অবস্থা। তাদের ভয়ে সবাই আতঙ্কিত। সীমার বহু অপকর্মে সহযোগিতা করে থাকে কালা রশিদ ও হাবিব। সীমা ক্যাম্পের আলফালাহ রোডে দীর্ঘদিন ধরে মাদকের স্থায়ী ঘাঁটি গেড়েছে। অপর মাদক সম্রাজ্ঞী পারুল। সেও ইয়াবা সম্রাজ্ঞী হিসেবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছে। দুই নারী জেনেভা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ থাকা শান্তি কমিটির সদস্য। কমিটির নেতাদের নেতৃত্বে ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকায় প্রকাশ্যে দেদার মাদক ব্যবসা চলছে। শান্তি কমিটিতে অন্তত ৪০ যুবক রয়েছে। যারা পুরো মাদক ব্যবসাসহ জেনেভা ক্যাম্পের অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পারুল মাদক সম্রাজ্ঞী সীমার কারণে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা করতে পারে না। সে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে ইয়াবা বিক্রি করে। কারাগারে থেকেই তার ইয়াবা ব্যবসা দেখভাল করে মুন্না ওরফে পোপলা মুন্না। বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গেলে স্থানীয় নারীরা অভিযোগ করেন, সীমা অনেক দিন ধরেই সাত নম্বর জেনেভা ক্যাম্পে মাদক বিক্রির চেষ্টা করছিল। তারই অংশ হিসেবে ক্যাম্পে যাওয়ার ভেতরের মূল রাস্তায় তার লোকজন দাঁড়িয়ে ইয়াবা বিক্রি করছিল। মাদক বিক্রি করতে তারা বাধা দেন। এ নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত। শান্তি কমিটির লোকজন এসে মাদক বিক্রিতে বাধা দেয়ার সূত্রধরে সাত নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ওপর চড়াও হয়। এক পর্যায়ে তারা ঘর থেকে নারী পুরুষ বের করে মারধর করতে থাকে। এতে বাধা দেয়। এরপরই শুরু হয় তুমুল মারামারি। প্রথমে হাতাহাতি পরে তা জোটবদ্ধ হয়ে ব্যাপক মারামারির আকার ধারণ করে। বাধাদানকারীদের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দেয়। এরপর অন্ধকার হলে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় তারাও অন্ধকারে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে নিরুপায় হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। দফায় দফায় এমন সংঘর্ষ চলে। রাত একটার দিকে পুরোপুরি বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে শান্তি কমিটির লোকজন দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। অনেক টিনের ঘর ভেঙ্গে দেয়। গুঁড়িয়ে দেয়া হয় অনেক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরে স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। বেলা এগারোটার দিকে আবার শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। ক্যাম্পজুড়ে তুমুল হৈচৈ আর গ-গোলে হার্ট এ্যাটাকে ক্যাম্পের এক বিহারী বয়স্ক মহিলার মৃত্যু হয়। এ সময় মারামারিতে মহিলার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট। মানুষজন যে যার যার মতো দৌড়ে নিরাপদ জায়গার দিকে চলে যেতে থাকে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। দুপুর দুইটার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। স্থানীয়রা জানান, শান্তি গ্রুপ মোহাম্মদপুরের ক্যাম্পগুলোতে মাদকসহ সব অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে আজম ও মোল্লা আনোয়ার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে। শান্তি গ্রুপের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ক্যাম্পের ৪০ হাজার বাসিন্দাসহ আশপাশের মানুষ। শান্তি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে অন্তত ৪০ মাদক ব্যবসায়ী। এরা হচ্ছে, আনোয়ার ওরফে মোল্লা আনোয়ার, আজম, শহিদ ওরফে কুলি শহিদ, নাদিম ওরফে বেজি নাদিম, আকরাম ওরফে চোরা আকরাম, আসলাম ওরফে ভেজাল আসলাম, রহমত, বরকত ওরফে কানা বরকত, রাজু ওরফে চুশনি রাজু, আলী ওরফে জিন্দা আলী, আশরাফ, রাজ ওরফে মুকবাকা রাজ, রহমান, রানো, দাউদ, ভলু, সেলিম ওরফে ভাইয়া সেলিম, সাহিল, তাওয়া, পোলার, টিপু, জাফর, কালে, আরমান, তানভির, জনি, সেলিম ওরফে চুসতা সেলিম, বিল্লু, আরিফ, সাজ্জাদ, সুমন, মুনির ওরফে কানা মুনির। সপ্তাহখানেক আগে শান্তি গ্রুপের কমান্ডার মোল্লা আনোয়ার ক্যাম্পে আসে। দীর্ঘদিন সে পলাতক ছিল। সে মাদক ও জাল টাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া সে জেনেভা ক্যাম্পের আশপাশে অবৈধ বিদ্যুত ও পানির সংযোগ দিয়ে থাকে। তার ঘনিষ্ঠ শাহিন ও নাদিম ওরফে ভেজি নাদিম। যারা বিহারী ক্যাম্পে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে ১৩২টি বোমাসহ গ্রেফতার হয়েছিল র‌্যাবের হাতে। মোল্লা আনোয়ার হেফাজতে ইসলামের ক্যাডার। ২০১৩ সালের ৫ মে আনোয়ার ওরফে মোল্লা আনোয়ারের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচীতে নাশকতা চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা বোমাবাজিসহ পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল।
×