ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্যাটি লিভার লিভারের অচেনা শত্রু

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১৫ মার্চ ২০১৬

ফ্যাটি লিভার লিভারের অচেনা শত্রু

ফ্যাটি লিভার, লিভারের একটি খুব সাধারণ রোগ। পশ্চিমা বিশ্বে এর প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। শতকরা প্রায় ২০ ভাগ আমেরিকান ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। জাপান ও ইতালিতে মোট জনসংখ্যার ৩০% থেকে ৫৮% এর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। আমাদের দেশেও এই চিত্রটি, বিশেষ করে শহর এলাকায়, খুব একটা অন্যরকম নয়। এদেশের ঠিক কত শতাংশ লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত সে সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে না থাকলেও একথা সত্য যে আমরা প্রায়ই ফ্যাটি লিভারের রোগীদের দেখে থাকি। ফ্যাটি লিভারের কারণ বহুবিধ। ডায়াবেটিস রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৩% ডায়াবেটিস রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে ৪৯% ভারতীয় যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত। ফ্যাটি লিভারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন, উচ্চরক্তচাপ, রক্তে চর্বি বেশি থাকা, থাইরয়েডের সমস্যা, ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি এবং ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। এটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ফ্যাটি লিভার, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস দেখা দিতে পারে যাকে আমরা বলি স্টিয়াটো হেপাটাইটিস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সম্প্রতি আমাদের পরিচালিত এক গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ওপর সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী যেসব রোগীদের স্টিয়াটো হেপাটাইটিস আছে, তাদের প্রায় ৩০% এর পরবর্তী সময়ে লিভারে সিরোসিস দেখা দিতে পারে। আর এদের কেউ কেউ লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন। অন্যান্য বেশিরভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মতো ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোন লক্ষণ থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পরার কথা বলে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এদের প্রায় ৫০%-এর লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশি থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই এ কথা বলা যায় না। ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আল্ট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটিস্ক্যান বা এমআরআই এক্ষেত্রে বেশি নির্ভরযোগ্য। তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষাটি হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নির্ভুলভাবে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্বন্ধেও একমাত্র এই পরীক্ষাটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায়। ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার একটি অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রুত অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে তাতে বরং হিতে-বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ওষুধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশন করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের কারণ নির্ণয় ও তার যথাযথ চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা থেকে লিভারকে রক্ষা ও পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য পৃথিবীতে ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ দেশে আমরাও এই বিষয়ে সিমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এ কথা ঠিক যে এখনও এজন্য শতভাগ কার্যকর কোন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশকিছু ওষুধ আছে যা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণিত। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে ইনসুলিন সেন্সেটাইজারস, আরসোডিঅক্সিকলিক এসিড, মিটাডক্সিন, প্রোবায়োটিক্স, ভিাটামিন-ই ইত্যাদি। একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হতো হার্ট বা ব্রেনে চর্বি জমে হার্ট-এ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু বিগত দশকে সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি আজ প্রমাণিত যে ফ্যাটি লিভার, লিভারে অন্যতম প্রধান রোগ। ২০০২ সালেও যেখানে লিভার রোগের প্রধান বইগুলোতে ফ্যাটি লিভারের ওপর আলাদা কোন চ্যাপ্টার ছিল না, সেখানে আজ লিভার রোগের যে কোন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বা নামকরা জার্নালগুলোর অনেকখানিই জুড়ে থাকছে ফ্যাটি লিভার। সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক এবং রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ শুরুতে ব্যবস্থা নিলে এ রোগ অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য। ডাঃ মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল) সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় লিভার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞ ইন্টারভেনশনাল এন্ডোস্কোপিস্ট ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটাল
×