ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রিয় নবী (সা.) -এর মহান মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৪ মার্চ ২০১৬

প্রিয় নবী (সা.) -এর মহান মর্যাদা

বিশ্ব জগত আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহুর কুদরতের এক অপূর্ব নিদর্শন। নূরে মুহম্মদী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ব জগত সৃষ্টির সূচনা করেন। তিনি প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করে তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর খ্যাতি ও আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। তিনি একমাত্র তাঁকেই নিজের হাবীব অর্থাৎ প্রেমাস্পদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিজের নাম মুবারকের পার্শ্বে তাঁর হাবীবের নাম যুক্ত করেছেন এভাবে : আমি কি আপনার বক্ষ আপনার কল্যাণে প্রশস্ত করে দেইনি? আমি আপনার বোঝা দূর করে দিয়েছি এবং আপনার খ্যাতিকে সুমহান মর্যাদায় উন্নীত করেছি (সূরা ইন্শিরাহ্্ : ১-৪)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহর প্রেমাস্পদ এবং আল্লাহ তাঁর প্রেমিকÑ এমন মহান মর্যাদা আল্লাহ জাল্লা শানুহু কেবল তাঁকেই দিয়েছেন। আল্লাহ্্ তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন, ফেরেশতারাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং মু’মিনদেরকে আল্লাহ্্ তা’আলা দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে: নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তার ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে মু’মিনগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও (সূরা আহ্্যাব : আয়াত ৫৬)। এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টির পটভূমি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খাতিরেই বিরাট বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন এবং একে করেছেন সুশোভিত ও সুসজ্জিত। আল্লাহ্্ হচ্ছে রব্বুল ’আলামীন অর্থাৎ বিশ্ব জগতের রব্্ আর তাঁর হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তিনি করেছেন রহমাতুল্লিল ‘আলামীন- বিশ্ব জগতের জন্য রহমত। এর মধ্যেই প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুমহান মর্যাদা নিহিত রয়েছে। রউফুর রহীম আল্লাহর দু’খানি মুবারক গুণবাচক নাম। আল্লাহ্্ তার এই দু’টি গুণবাচক নামে তাঁর হাবীরেরও পরিচিতি করেছেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট এক রসূল এসেছেন। তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মু’মিনদের প্রতি তিনি রউফুর রহীম- দয়ার্দ্র পরম দয়ালু (সূরা তওবা : আয়াত ১২৮)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত আদম ‘আলায়হিস্্ সালামের বহু পূর্বে ঊর্ধ্ব জগতে নবুওয়াতের অভিষেকে অভিষিক্ত হন। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু তাঁরই মাধ্যমে নবুওয়াতের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার সূচনা করেন এবং তার দ্বারাই পৃথিবীতে নবী আগমন ধারার সমাপ্তি ঘটান। তিনিই সর্বপ্রথম এবং তিনিই সর্বশেষ। তিনি সাইয়েদুল মুরসালীন আবার তিনিই খাতামুন্নাবীয়ীন । তিনি বলেছেন : অমি রসূলগণের ভূমিকা, আমি নবীদের উপসংহার-এতে আমার কোন ফখর (অহংকার) নেই। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমেই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন আল ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমরা জানি প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে ইসলাম প্রচার করতে যেয়ে যারপরনেই জুলুম, নির্যাতন নিপীড়ন সইতে হয়েছে। তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। তিনি এক পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করেছেন। এখানে গড়ে তুলেছেন এক আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র কিন্তু শত্রুরা বসে থাকেনি। মক্কার কাফির-মুশরিকরা মদীনায় ইয়াহুদী ও মুনাফিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে মদীনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। যুদ্ধের পর যুদ্ধ হয়েছে। সব যুদ্ধই ছিল শত্রু বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার। সব যুদ্ধে শত্রু বাহিনী পরাজিত হয়েছে। অতঃপর মক্কা বিজয় হয়েছে। ঘোষিত হয়েছে : সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ্জ ইন্তিকালের মাত্র ৯০ দিন পূর্বে তিনি হজ্জ করতে এসেছেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে। বিদায় হজ্জ নামে পরিচিত এই হজ্জকে হুজ্জাতুল ইসলাম, হুজ্জাতুল বালাগ নামেও অভিহিত করা হয়। তিনি সেদিন আরাফাত ময়দানের সেই বিশাল জনতাকে উদ্দেশ করে যে ভাষণ দেন তা বিদায় হজ্জের ভাষণ বা খুতবা নামে পরিচিতি। এই খুতবায় তিনি বললেন : আজ আমার পায়ের তলায় অন্ধকার যুগের সকল অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, শিরক, কুফর দলিত-মথিত হলো। তিনি বললেন : আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদটির মতো তোমাদের একের ধনসম্পদ, মান-ইজ্জত, জান-প্রাণ-রক্ত অপরের নিকট পবিত্র। তিনি সেদিন এই দীর্ঘ ভাষণ শেষে সবাইকে আল বিদা জানান। আর তখন নাযিল হয় : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার সব নিয়ামত তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবের আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। আল্লাহ ছিলেন এক গুপ্ত খাজিনা। তিনি প্রকাশ হবার ইরাদা করে প্রথমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূর সৃষ্টি করেন। এই নূরই নূরে মুহম্মদী। এই নূর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাবত মখলুক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হযরত আদম (আঃ) যখন পানি ও মাটির মধ্যখানে ছিলেন তখন আমি খাতামুন্নাবীয়ীন বা নবীগণের সমাপ্তি হিসেবে বিদ্যমান ছিলাম। একজন সাহাবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রসূলাল্লাহু, আপনাকে কখন নবী করা হয়েছে? উত্তরে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমার নিকট হতে যখন নবুওয়াতের মীসাক (অঙ্গীকার) নেয়া হয় তখন আদম রূহ ও দেহের মধ্যখানে ছিলেন। হযরত ইব্্রাহীম আলায়হিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে যখন কা’বা ঘরের দেয়াল তুলছিলেন, তখন আল্লাহ জাল্লা শানুহুর দরবারে এই বলে দু’আ করেছিলেন : হে আমাদের রব্। আমাদের দু’জনকে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার এক অনুগত উম্মত করো। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের রব্্! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রসূল প্রেরণ করো যে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৮-১২৯)। হযরত ‘ঈসা আলায়হিস সালাম বনী ইসরাঈলদের নিকট প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম বলেছিলেন : হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তওরাত আছে তার আমি সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহ্্মদ নামে যে রসূল আসবেন আমি তাঁর সুসংবাদদাতা (সূরা সাফ্্ফ : আয়াত ৬)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু এতই ভালবাসেন যে, তিনি তাঁর নাম ধরে ডাকেননি। কোরআন মজীদে ইয়া আদাম! ইয়া মুসা ইত্যাদিভাবে নবীগণকে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে এভাবেÑ ইয়া আইয়োহান্নাবী, ইয়া আইয়োহাল মুদ্্দাছ্ছির, ইয়া আইয়োহাল মুয্্যাম্মিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মহিমা ও গুণ-মাধুর্য জগতজুড়ে সৌরভ বিলিয়ে আসছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁর জীবনচরিত রচিত হয়েছে। বিভিন্ন কালে জ্ঞানী-গুণী মনীষীগণ তাঁর প্রশংসায় মুখরিত হয়েছেন। জেএইচ ডেনিসন এ্যাজ দ্য বেসিস অব সিভিলাইজেশন গ্রন্থে লিখেন : পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে, সভ্য জগত উপনীত হয়েছে নৈরাজ্যের তুঙ্গে, তখন এটাই প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, চার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিশাল সভ্যতা বিখ-িত হওয়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং মানব জাতি বর্বরতার চরম অবস্থায় যেন ফিরে গিয়েছে, যেখানে প্রতিটা জাতি ও গোত্র পরস্পরের বিরোধী ছিল, আইনশৃঙ্খলা বলতে কোথাও কিছু ছিল না। খ্রিস্টধর্মের দ্বারা নিত্যনতুন নিয়ম-অনুশাসন ঐক্য ও শৃঙ্খলার বদলে বিভেদ ও ধ্বংসের কাজ করছিল। এই জনগোষ্ঠীর (আরবদের) মধ্যে সেই পুরুষপ্রবর জন্মগ্রহণ করলেন, যিনি পূর্ব ও দক্ষিণের সমগ্র জানা দুনিয়াকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য আবির্ভূত হলেন। হিরো এ্যান্ড হিরো ওয়ারশিপে স্যার টমাস কারলাইল লিখেছেন:Ñ সে এক মহাপরিবর্তন কি এক দারুণ পরিবর্তন ও প্রগতি সূচিত হলো মানবকুলের বিশ্বজনীন অবস্থায় ও চিন্তায়! আজকের যুগে আল্লাহর বৃহত্তর সংখ্যক মুখ্্লুক অন্য যে কোনো বাণীর চেয়ে হযরত মুহম্মদ (সা.) এর বাণী বেশি বিশ্বাস করে।... আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের মধ্যেই ইসলামের অর্থ নিহিত রয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীতে নাযিলকৃত আসমানী জ্ঞানের মধ্যে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। আরব জাতির জন্য এটা ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ! আরব এরই পরশে প্রথমবারের মতো যিন্দা হয়ে উঠল। টমাস কারলাইল অন্যত্র বলেন : এক জাতি, তাঁর নাম আরব, একজন মানুষ নাম তাঁর মুহম্মদ (সা.) আর সেই একটা শতাব্দী। এটা কি তাই নয়, যেন একটি স্ফুলিঙ্গ, শুধুমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গ পড়ল এমন এক পৃথিবীর উপর, যা দেখে মনে হতো তমশাচ্ছন্ন অজ্ঞাত বালুকণা, কিন্তু দেখো! সেই বালুকণা বিস্ফোরিত হলো বারুদের মতো আকাশ সমান আলো করে আর সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মহান মর্যাদা সম্পর্কে অমর কবি মওলানা আবদুর রহমান জামীর আরবী-ফারসী মিশানো ছন্দোবদ্ধ চার পঙ্ক্তিমালার বাংলা অনুবাদ এরূপ : হে সৌন্দর্যের অধিপতি, হে মানবকুলের সরদার/তোমার চেহারার জ্যোতিতে আলোকিত হয়েছে চন্দ্র/আমার কাছে নেই কোনো যোগ্য ভাষা তোমার প্রশংসা করার/সংক্ষিপ্ত সারকথা হলো আল্লাহ্্র পরেই তোমার মর্যাদা। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×