ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবারের বড়দের নানা বিরোধের বলি হচ্ছে কোমল শিশুরা

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৩ মার্চ ২০১৬

পরিবারের বড়দের নানা বিরোধের বলি হচ্ছে কোমল শিশুরা

আরাফাত মুন্না ॥ নিজেদের কোন অপরাধ নেই। কেন হত্যা করা হচ্ছে, সে বিষয়টিও অবগত নয়। এর পরও পৈশাচিক হত্যার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। পারিবারিক কলহ, যৌতুক, পরকীয়া, অপহরণসহ পরিবারের বড়দের নানা বিরোধের বলি হচ্ছে জাতির ভবিষ্যতরা। প্রতিবছর শিশুহত্যার সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলও বদলাচ্ছে হত্যার ধরন। কখনো শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে পায়ুপথে বাতাস দিয়ে আবার কখনও রড দিয়ে আঘাত করে। এমনকি জন্মদাতা মা-বাবার হিংস্র থাবা থেকেও শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। গত চার বছরে সারা দেশে ১ হাজার ৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে চলতি বছর দুই মাসে হত্যার শিকার হয়েছে ৪৯ শিশু। বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সোমবার সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপ্তি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সাম্প্রতিক শিশু হত্যাগুলো ঘটানো হচ্ছে নানা ধরনের ফায়দা হাসিলের জন্য। প্রতিটিই হৃদয়বিদারক, পৈশাচিক। সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে তোলপাড় হলেও দেশে শিশুদের সুরক্ষায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সভ্যতার বিকাশের আগে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিশু ও নারীদের আক্রমণ করত সবল পুরুষরা। আকাশ সংস্কৃতি এবং অনলাইন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব, মাদকের প্রভাব এবং বিচারহীনতার কারণে সেই ‘বিকৃত আচরণ’ বার বার ফিরে আসছে। তারা আরও বলেন, শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করে সেসব মানবাধিকার সংগঠন এবং পুলিশ-প্রশাসনও শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ এবং সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এনজিওর কাজ। শিশুদের সহায়তা দিতে প্রতিটি থানায় ‘শিশু ডেস্ক’ চালু করার কথা থাকলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মম আচরণ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে কাউন্সিলিং করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, দেশে শিশু আইন আছে, শিশু অধিকার সনদ আছে। যেখানে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে, শিশুকে শারীরিক তো নয়ই, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা নিষিদ্ধ। আছে শিশুশ্রমের বিপরীতে কঠোর শাস্তির বিধানও। যার প্রয়োগের অভাবকেই দায়ী করছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২ শিশু, ২০১৪ সালে ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। চার বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। বিএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ৪০ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। গত বছর মোট অপহরণের শিকার হয় ২৪৩ শিশু। এর মধ্যে ১৬৭ শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৪ সালে অপহৃত হয় ১১৮ শিশু, যার মধ্যে ৫০ শিশুকেই মেরে ফেলা হয়। ৬৬ শিশুকে অপহরণের পর উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ৪২ শিশু অপহরণের শিকার হয়, যার মধ্যে মেরে ফেলা হয় ১৩ জনকে। এর আগে ২০১২ সালে ৬৭ শিশু অপহৃত হয়েছিল। গত বছর ৪৩ শিশু তার মা, বাবা বা কোন আত্মীয়ের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪ সালেও এভাবে খুন হয় ১৫ শিশু। বিএসএএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারিতে ২৯ শিশু খুন হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারিতে ২০ শিশুকে হত্যা করা হয়। বিএসএএফের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পারিবারিক কলহ, যৌতুক, অনৈতিক সম্পর্ক, মুক্তিপণ না পাওয়া, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদকাসক্তির কারণেই বেশি শিশু হত্যা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর বনশ্রীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণীর ইশরাত জাহান অরনি (১৪) ও তার ছোট ভাই হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারি শ্রেণীর আলভি আমানের (৬) রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্বজনরা দাবি করে, দুই শিশু রেস্টেুরেন্টের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। তবে ময়নাতদন্তে দুজনকেই শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এর আগে গত শনিবার কুমিল্লা শহরের রসুলপুরে মেহিদী হাসান জয় (৮) ও মেজবাউল হক মনি (৬) নামে দুই শিশু খুন হয়। মঙ্গলবার রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুই শিশুর সৎ ভাই আল শফিউল ইসলাম ছোটনকে (২২)। সে জিজ্ঞাসাবাদে, দুজনকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের বাহুবলের ভাদেশ্বর ইউনিয়নে মাটি খুঁড়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে। ঘটনার চারদিন আগে থেকে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তাজেল মিয়া (১০), মনির মিয়া (৭) এবং ইসমাঈল হোসেন (১০) নামে ওই চার শিশু নিখোঁজ ছিল। পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা বলছে, বড়দের পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে গত বছর সিলেটে রাজন, খুলনায় রাকিব, বরগুনায় রবিউল ও ঢাকায় নাজিমসহ কয়েক শিশু হত্যার ঘটনায়ও ব্যাপক তোলপাড় হয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সাম্প্রতিক শিশু হত্যাগুলো ঘটানো হচ্ছে নানা ধরনের ফায়দা হাসিলের জন্য। গত কিছুদিনে কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার প্রতিটিই হৃদয়বিদারক ও পৈশাচিক। বুধবার সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে শিশুহত্যা, ব্যাংক কার্ড জালিয়াতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখোমুখি হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রামপুরার ভাই-বোন হত্যার তদন্ত নিয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন ‘দুই শিশু হত্যা কেন হয়েছে, তা তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের আগে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমরা সন্দেহ করছি অনেক কিছু।’ সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকা-ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, হত্যাকারীরা সেই শিশুর কাছের আপনজন। এখানে অনেক বাবা-মাও শিশু হত্যার সঙ্গে কোন কোন জায়গায় জড়িত, পাড়াপ্রতিবেশী জড়িত, সম্পত্তির লোভও থাকতে পারে। সিলেটের রাজন হত্যার বিচারের প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি শিশু হত্যার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা হঠাৎ বেড়েছে, এমনটি নয়; এগুলো ঘটেই চলেছে। লোভ-লালসা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পরকীয়াসহ নানা কারণে শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। এখন মূলত গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব ঘটনা দ্রুত জানা যাচ্ছে। আলোচনায় আসছে। তবে প্রতিকার হচ্ছে না। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে ব্যাপক সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যেটি আসলে নেই। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা দরকার। শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সিলিং চালু করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও অনেক স্থানে শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি। এখনও শিশু ও নারীরা দুর্বল ভেবে তাদের বেশি নির্যাতন করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানসিক অস্থিরতা বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবারে বা বাইরে শিশুদের রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ কম। এ জন্য টিভি ও অনলাইনের কিছু নিয়ন্ত্রণ আনা দরকার। পাশাপাশি সচেতনতার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, এখনও শিশুরা দুর্বল বলে তাদের ওপর আঘাত করা হয়। শিশু নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বন্ধে ২০১৩ সালে শিশু অধিকার আইন করা হলেও এখনও বিধি করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। পুলিশের শিশু ডেস্ক কাগজে কলমেই ॥ শিশু হত্যা, নির্যাতন প্রতিরোধ ও শিশুদের আইনী সেবা দিতে গত বছরের আগস্টে দেশের প্রতিটি থানায় শিশুবিষয়ক ডেস্ক স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছিল পুলিশ সদর দফতর। এতে শিশুদের অভিযোগ তদন্তে আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও বলা ছিল। এর আগে শিশু আইন ২০১৩’তে প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্ক ও আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়। তবে ওই আইন পাসের দুই বছর এবং পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনার ছয় মাস পার হলেও থানাগুলো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। রাজধানীর কয়েকটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে শিশুদের জন্য আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ ও শিশু ডেস্ক স্থাপন করা হয়নি। কয়েকটি থানায় সার্ভিস ডেলিভারি বা অন্য ডেস্কের সঙ্গে শিশু ডেস্ক স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ শিশু আইনে শিশুদের জন্য আলাদা ডেস্ক স্থাপনের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ডভিশন ও সেন্টার ফর সার্ভিস এ্যান্ড ইনফর্মেশন অন ডিজএ্যাবিলিটি নামে দুটি বেসরকারী সংস্থা ঢাকার ১৩টি ওয়ার্ড এবং ৩৪টি জেলার থানায় অনুসন্ধান চালিয়ে শুধু ঢাকার সাতটি থানায় শিশু ডেস্ক থাকার কথা জানতে পেরেছে। তবে কোথাও আলাদা শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা পাওয়া যায়নি। ওয়ার্ল্ডভিশনের ন্যাশনাল এ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর (শিশু সুরক্ষা ও শিক্ষা) সাবিরা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, বেশিরভাগ থানা থেকে শিশু ডেস্ক এবং আলাদা কর্মকর্তা থাকার বিষয়টি দাবি করা হলেও দৃশ্যত তা দেখা যায়নি। কয়েকটি থানায় ডেস্ক ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হলেও তাদের দৈনন্দিন অন্য পুলিশী কাজ থাকায় নিজেদের ডেস্কে সময় দিতে পারেন না ওই কর্মকর্তারা।
×