ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি দিয়ে মোকাবেলা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১ মার্চ ২০১৬

সংস্কৃতি দিয়ে মোকাবেলা

যে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশও তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করতে পারে। এদেশের জনপদ অত্যন্ত প্রাচীন। ফল-ফুল-শস্য-শ্যামলে উর্বর ও আকর্ষণীয়। আর তাই সেই আদিকাল থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল হতে মানুষ এ দেশের মাটি ও মানুষের আকর্ষণে এসেছে, বসতি স্থাপন করেছে। সত্যি বলতে কি, এই অঞ্চলের মূল সুর সকল বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সাধন, বৈচিত্র্যের মধ্যে আত্মানুসন্ধান, সর্বোপরি দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবের সংস্কৃতি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের এই সুর ও সংহতিই এদেশের প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও এর জের অনেকাংশে অপনোদন হয়েছে এমন কথা বলা যাবে না। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে সংস্কৃতির বিভাজনের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিককালে ভারতে গো-মাংস খাওয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাত ও অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তাতে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ততধিক শোচনীয় অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায় পাকিস্তানেও। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই ধর্মের নামে মৌলবাদী জঙ্গীদের অপতৎপরতা, বোমা হামলা, নির্যাতন-নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটছে। তারা সে দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানাতে চায়। শ্রীলঙ্কায় সিংহলিজ ও তামিলদের মধ্যে জাতিগত বিভাজন এবং নেপালে মদেসীয় ও নেপালীদের বিভেদও সে সব দেশে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা জাতি গঠন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে অবশ্যই অন্তরায়। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ অনুরূপ সমস্যা-সঙ্কট থেকে অনেকটাই মুক্ত। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লাখ শহীদান ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। তদুপরি বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। তারপরও এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত মাঝে-মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অপপ্রয়াস চালায়; সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, হিংসা, দ্বেষ, ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টাসহ জঙ্গীবাদী-মৌলবাদী তৎপরতা চালানোর অশুভ চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সফলকাম হবে না। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সর্বদাই সমুন্নত রেখে জাতীয় সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অনুসরণে নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে সংস্কৃতির সংগ্রাম। সুমহান ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনাকে বিন্যস্ত করে জনজীবনের সর্বস্তরে বিকাশ ঘটাতে হবে অসাম্প্রদায়িকতার, নারী-পুরুষের সমতার, মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের। এর জন্য সুশিক্ষার পাশাপাশি আবশ্যক শিল্প-সাহিত্য-নাটক-ভাস্কর্য-স্থাপত্য ও সঙ্গীতের। এ সবের মধ্যেই থাকতে হবে ঐক্য ও সমন্বয়ের সুর, ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন তথা ঐকতান। মনে রাখতে হবে এদেশের কবিই উচ্চকণ্ঠে গেয়েছেন জীবনের জয়গান, সর্বোচ্চ শিখরে মেলে ধরেছেন মানবিকতাকে। শুধু সরকারী উদ্যোগে, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি দিয়ে এই বিশাল কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। বরং সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য এবং সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সর্বাধিক প্রয়োজন গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এ যেন অনেকটা আলো দিয়ে আলো জ্বালার মতো। আর তাহলেই লাখ লাখ কোটি কোটি ঘরে জ্বলে উঠবে সম্প্রীতির আলো।
×