ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় কাশিমবাজার কুঠির ভূমিকায় পাকিস্তান দূতাবাস

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঢাকায় কাশিমবাজার কুঠির ভূমিকায় পাকিস্তান দূতাবাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গীবাদ এখন দেশে দেশে আতঙ্কের মূর্ত প্রতীক। জঙ্গীবাদ বাংলাদেশকেও গিলে খাচ্ছে। এখান থেকে বেড় হতে না পারলে সমাজ জীবন চরম হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই সময় এসেছে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে বৃহত্তর রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করার। এমন আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। শনিবার স্থানীয় একটি হোটেলে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বা আই ক্ল্যাডস আয়োজিত সেমিনারে তারা এই আহ্বান জানিয়েছেন। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বিদেশী সমর্থন ও অর্থায়নেই দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটছে বলে সেমিনারে বলা হয়। এ কারণে বিদেশী অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারিরও জন্য সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসকে কাশিমবাজার কুঠি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ধুয়া তুলে মুক্ত চিন্তার লেখকদের কণ্ঠরোধ করে জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে এমন বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আই ক্ল্যাডস’র চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাহাম্মদ জমীরের সভাপতিত্বে ‘জঙ্গীবাদ বিস্তারে বিদেশী হাত’ শিরোনামের এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আই ক্ল্যাডসের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম অহিদুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান, মঈনুদ্দিন খান বাদল এমপি, আব্দুল ওয়াদুদ দারা এমপি, মাহজাবীন খালেদ এমপি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম, অধ্যাপক জিনাত হুদা, জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, রিজিওনাল টেররিজম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, সমকালের সহযোগী সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নুজহাত চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবিব, সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি, সাংস্কৃতি কর্মী ও অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গবর্নরস’র গবর্নর মওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, আহমাদিয়া মুসলিম জামায়াত, বাংলাদেশ‘র মিশনাররি ইনচার্জ মওলানা আব্দুল আউয়াল খান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক রাশেকুর রহমান এবং আই ক্ল্যাডসের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো সারওয়ার জাহান চৌধুরী। সেমিনার সঞ্চালনা করেন মিথিলা ফারজানা। মূল প্রবন্ধে আই ক্ল্যাডস‘র নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে পাক-মার্কিন অনুচরেরা উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। তখন দেশে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলতে থাকে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা। ওয়াজ মাহফিল, মসজিদে বয়ান, মাদ্রাসা থেকে জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উৎখাত, বাঙালী সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে অনৈসলামিক ঘোষণা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নাষ্টিক আখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী কৌশল বাস্তবায়ন কাজ চলতে থাকে। বাংলাদেশে মৌলবাদী দীক্ষার কাঠামো তৈরিতে বিদেশী হাত এমনভাবে কাজ শুরু করে যে, এই সময়ে এসে তার বিস্তার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জঙ্গীবাদের বৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশকে অশান্ত অস্থিতিশীল করে রাখার বিষয়টি এখনও চলছে। এই হাত এমনভাবে কাজ করছে যে, তা নির্মূল করা কঠিন। অধ্যাপক হারুন উর রশীদ বলেন, দেশের ভেতরে জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে সংকীর্ণ রাজনীতি যারা পাকিস্তানের প্রতি এখনও অনুগত। এই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঢাকায় কাশিবাজার কুঠির ভূমিকায় থাকা পাকিস্তানী দূতাবাসের দিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। এই দূতবাসের কর্মকর্তারা জঙ্গীবাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রয়োজনে পাকিস্তান দূতাবাস তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল বলেন, জঙ্গীবাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে আগাতে হবে। হুট করে সৌদি জোটে যোগ দেয়া সেই বিবেচনায় মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ এ সিদ্ধান্তের জন্য আইএস জঙ্গীদের টার্গেট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সংসদে আলোচনা না করে কিভাবে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা যায় সেটাই করা উচিত। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জঙ্গীবাদীদের মৌলবাদী না বলে চরমপন্থী বা উগ্রপন্থী বলা উচিত। কারণ মৌলবাদী শব্দের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা ধর্মের মৌলিক বিষয়ই মৌলবাদ ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ওহাবি সুন্নী ছাড়া বাকি সবাই আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদের টার্গেট হচ্ছে, এ বিষয়গুলো গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সৌদি আরবের মতো দেশ নানাভাবে জঙ্গীবাদের অর্থায়ন করছে। যেমন মীর কাশেম আলী সৌদি আরবে গিয়ে বলেছিল, ভারত বাংলাদেশে সব মসজিদ ভেঙ্গে দিয়েছে। মসজিদ পুনর্গঠনের নামে সে কোটি কোটি টাকা নিয়ে এসে নিজের ব্যবসা শুরু করে। পরে সেই টাকা জঙ্গী মানসিকতা তৈরিতেও ব্যয় করে। ব্রিটিশ তার উপনিবেশ বহাল রাখার জন্য বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল। সেই ধারা এখনও আছে। সাধারণ, মাদ্রাসা এবং ইংরেজী মাধ্যম এই তিন ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিভক্ত রেখে কোনভাবেই জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সবার আগে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর আহ্বান জানান। অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, এখন আধুনিক তরুণীদের মধ্যে পোশাকেও সাম্প্রদায়িকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হিজাবের আধিপত্য বাড়ছে, বাঙালীর শাড়ি উঠে যাচ্ছে। এ ধরনের অবস্থা কাম্য হতে পারে না। এয়ার কমোডর (অব) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভেদের সুযোগ নিয়েই বিদেশী শক্তি জঙ্গীবাদ বিস্তারের চেষ্টা করছে। এ কারণে জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রয়োজন। অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, বিভিন্ন সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাম্পদায়িকতার থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব একটা এগোচ্ছে না। এখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার বিষয়ে প্রশাসন অনেক বেশি উচ্চকিত। কিন্তু জঙ্গীরা যখন মুক্তমনা লেখক, ব্লগারদের হত্যা করছে, তখন প্রশাসনকে খুনীদের ধরার বিষয়ে তৎতর দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজšে§র মুক্তমনা লেখক, ব্লগারদের টুটি চেপে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী চেতনাই উৎসাহিত হচ্ছে। জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করতে হলে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। মেজর জেনারেল (অব) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোকে কিভাবে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। মওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, এখন অনেক মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখানে বিদেশী টাকায় জঙ্গী মানসিকতা শেখানো হচ্ছে। তারা সরকারী সহায়তা নেয় না, কিন্তু কালো টাকার মালিকদের টাকা নেয়, এমপিদের কাছে গিয়ে টিআর, কাবিখার টাকার জন্য বসে থাকে। ধর্মে শিক্ষা ক্ষেত্রে জাকাত, ফিতরা, চামড়ার টাকা নেয়া জায়েজ না হলেও মাদ্রাসার ছাত্রদের ভিক্ষুক বানিয়ে সেই টাকা নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অন্য কোথাও নেই। সুশিক্ষিত হয়, এমন শিক্ষা ব্যবস্থা সবার আগে প্রয়োজন।
×