ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল খায়ের ভুঁইয়া

অভিমত ॥ মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অভিমত ॥ মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জরুরী

যে কোন ধরনের মাদকই হোক না কেন তা কোন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। মাদক একটি অভিশাপ। মানুষের জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিতে পারে এই মাদক। আজকের এই মাদক শুধু বখে যাওয়া তরুণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে শিশু ও কিশোরদের মধ্যেও। বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার শুধু পুরুষই নয়, আজকাল মহিলাদের মাঝেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকের আগমন ও বিস্তারের পথ দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে শহর-বন্দর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত অলিগলি পর্যন্ত। পত্রিকা মারফত জানা যায়, প্রতিদিন শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই ইয়াবা বাবদ হাত বদল হয় ৭ কোটি টাকা। ইয়াবা সেবনের টাকা যোগাড় করতে না পেরে অনেকেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো জঘন্যতম কাজও করছে অনায়াসে। আবার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েও প্রতিনিয়তই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। মোট কথা, নেশার কারণেই আজ সমাজে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। বিভিন্ন সময়ে মাদক সেবক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মাসোহারার টাকা নিয়ে বনিবনা না হলে নাকি মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। তাছাড়া অভিযানের সময় আটককৃতদের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার অভিযানের সময় আটককৃত মালামাল থানায় জমা দেয়ার সময় বা মিডিয়ার সামনে প্রচারের সময় নাকি অর্ধেকও হয়ে যায়। বাকি মাল পুলিশ সদস্যরা আবার মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে দেয়। প্রতিদিনই এভাবে মাদকের অসংখ্য চালান ধরা পড়ছে। তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। হাত বাড়ালেই মিলছে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা জাতীয় নেশাদ্রব্য। নেশার নীল ছোবলে আজ ধ্বংসের পথে যুবসমাজ। মাদকাসক্তির কারণে পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। ইয়াবা ট্যাবলেটকে কেউ বলে জিপি, কেউ বলে পিল, কেউ বলে মাল, কেউ বলে মুরুব্বি, কেউ বলে হর্সপাওয়ার, কেউ বলে বাবা, কেউ কেউ আবার আদর করে ডাকেন মারহাবা কিংবা গুটি নামে। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন ভয়ঙ্কর এই মাদক ইয়াবাকে মাদক ব্যবসায়ীরা ও সেবনকারীরা বাবা সাংকেতিক নামেই বেশি ডাকেন। অভিজাত নেশাগ্রস্তদের কাছে এটি আইস পিল নামেও পরিচিত। ইয়াবা মাদক রাজ্যে এক হট আইটেম। কক্সবাজার সীমান্ত হয়ে বানের পানির মতো ভেসে আসছে মরণ নেশা ইয়াবা। বাংলাদেশকে টার্গেট করে সীমান্তে গড়ে ওঠা কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা ঠেলে দেয়া হচ্ছে এপারে। সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবির সতর্ক টহল এবং কড়া নজরদারিতেও বন্ধ হচ্ছে না মরণ নেশা ইয়াবার চালান। কক্সবাজারের টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে আসা ইয়াবা সমুদ্র ও সড়কপথে চট্টগ্রাম হয়ে সুস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কিছু মাদকের চালান ধরা পড়লেও বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতিদিন নেশাদ্রব্যের পেছনে জাতীয় অপচয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ২.২ শতাংশেরও বেশি। মিয়ানমারের মংডু এলাকায় ৪-৫টি কারখানা শুধু বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে ইয়াবা তৈরি করছে। এছাড়াও ভারতের তিনটি সীমান্ত দিয়ে অনবরত আসছে বিভিন্ন ধরনের মাদক। সমাজে ও শিক্ষাঙ্গনে মাদকের ছোবল রুখতে হবে। মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশের যুবসমাজ। বস্তির দরিদ্র ছেলে থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত এলাকার ধনীর দুলাল এখন মাদকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি স্কুলের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত মাদকের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক বিকৃতি ঘটে। ফলে দেশে দিন দিন সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন, চুরি, ডাকাতির মতো মারাত্মক অপরাধগুলোর সঙ্গে মাদকসেবীরাই যুক্ত। আর তাই জাতি হাঁটছে অন্ধকারের দিকে, মৃত্যুর দিকে হাঁটছে নৈতিক মূল্যবোধ এবং জন্ম নিচ্ছে ঐশীর মতো পিতামাতা হত্যাকারী সন্তানরা। তাই সমাজ ও জাতির স্বার্থে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। মাদক গ্রহণকারীদের সংশোধন কেন্দ্রের মাধ্যমে সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) জরিপ মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। মাদকসেবীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। আর অধিকাংশই এখন ইয়াবায় আসক্ত। সীমান্তবর্তী ২৯টি জেলার মধ্যে ১৩২টি উপজেলা দিয়ে সরাসরি মাদক বহন করা হচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবর বেরিয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষ ইয়াবা সেবন করেন। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের সঙ্গেও রয়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের ভাল সম্পর্ক। সরিষার মধ্যে ভূত রেখে ভূত তাড়ানো কি সম্ভব? পুলিশের কিছু কর্তাব্যক্তিও মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। রক্ষকই যদি ভক্ষকের ভূমিকায় থাকে তাহলে আর কিছু বলার থাকে না। একেই বলে সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা? জনপ্রতিনিধিরা জনসেবা বাদ দিয়ে যখন জনঅস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান তখন দেশে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। মাদক সেবনের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্কের কিছু কোষের অপমৃত্যু ঘটে। এভাবেই হৃৎপি-, ফুসফুস ও কিডনি বিকলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নেশায় আসক্তদের। এ মরণনেশা প্রতিরোধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কোন জিনিস সহজলভ্য হলে তার বিস্তার ঘটে খুব দ্রুত। মাদকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সূত্র থেকে জানা যায়, গত ছয় বছরে মাদক উদ্ধার বা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন সাফল্য চোখে না পড়লেও নতুন বছরের প্রথমেই ব্যাপক পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অবশ্যই এটা কৃতিত্বের দাবি রাখে। নীরব ঘাতকের মতো মাদকাসক্তি প্রসার লাভ করছে। মাদকাসক্তি আমাদের কর্মশক্তির বড় একটি অংশ আগামী দিনের নাগরিকদের গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। এ পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। মাদককে না বলুন- ঘরে ঘরে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। প্রশাসনের মাদকবিরোধী সভা-সেমিনার, বিজিবি ও পুলিশের অভিযানসহ মসজিদভিত্তিক জনসচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণের পরও প্রতিদিন বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের নীল ছোবলে একেকটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজের সম্ভাবনাময় শক্তি। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশে ইয়াবা আসে মূলত মিয়ানমার থেকে। সূত্র থেকে জানা যায়, এই ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় অর্ধশতাধিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করা। আর একে ঘিরে টেকনাফ, কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তবর্তী এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে অনেক চোরাচালান চক্রের। চোরাচালান চক্রের মাধ্যমেই ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কম-বেশি মাদক সমস্যা বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এর ব্যাপকতা অনেক। মাদক ও মাদকাসক্তি এখন বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যে যুব সমাজের ওপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি-অগ্রগতি ও ভবিষ্যত নির্ভরশীল, তারাই যদি মাদকাসক্ত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ঙ্কর অভিশাপ থেকে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। khayar15bhui“[email protected]
×