ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু

যেভাবে অনুমোদন পেল অনলাইন একুশের ডাকটিকেট

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

যেভাবে অনুমোদন পেল অনলাইন একুশের ডাকটিকেট

শহীদ মিনার আমাদের অস্তিত্ব আর চেতনার প্রতীক। আমেরিকাতে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব, উৎসব ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপর প্রতিবছর নতুন নতুন ডাক টিকেট চালু করা হয়। আর এই ডাক টিকেটগুলোর অনুমোদনের জন্যে একটি পরামর্শক বোর্ড রয়েছে। ইউএস পোস্টাল সার্ভিস সিটিজেন এ্যাডভাইজারি বোর্ড যারা নির্ধারণ করেন ডাক টিকেট বিষয়গুলো নিয়ে যেমন এর প্রয়োজনীতা কেন, শিক্ষণীয় বিষয় কি আছে এবং ডাক টিকেটের ডিজাইন কেমন হবে নানা খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে এর প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। কোন ডাক টিকেট এই বোর্ড দ্বারা অনুমোদিত হলে তবেই যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সকল ডাকঘর থেকে সংগ্রহ করা যাবে। আর কোন নতুন ডাক টিকেটের জন্যে আবেদন জানানো হলে এর শর্ত বেশ জটিল- যেমন গতানুগতিক ডাক টিকেট ছাড়াও রয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কন, এলভিস প্রিসলি, মার্টিন লুথার কিং ইত্যাদি। একমাত্র ‘ইউএস পোস্টাল সার্ভিস সিটিজেন এ্যাডভাইজারি বোর্ড’ সংরক্ষণ করে কোন কোন নতুন ডাক টিকেট স্থানীয় ডাকঘর থেকে বাজারজাত করা হবে। অনলাইন ডাক টিকেট আর যে কোন ডাকঘর থেকে কেনা ডাক টিকেটের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই- একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। আর সেটি হচ্ছে- অনলাইন ডাক টিকেট শুধু অনলাইনে সংগ্রহ করা যাবে স্থানীয় ডাকঘর থেকে নয়। দৈনন্দিন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ডাক সরবরাহে কোন পার্থক্য নেই। আমরা একবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সকল মুসলমান ধর্মাবলম্বী আবেদন করেছিলাম- ‘ঈদ মোবারকের’ ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ডাক টিকেট চালু করার জন্য। অনেকদিন আগের কথা সেই সময় শর্ত দেয়া হয়েছিল একলাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে এই প্রস্তাবিত ডাক টিকেট চালু করার পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল স্বাক্ষর সংগ্রহ করে পাঠাতে। সেখানে এক লাখের জায়গায় প্রায় দশগুণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে অনুমোদনের জন্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে ‘ঈদ মোবারক’ ডাক টিকেট আজও বিদ্যমান রয়েছে। অনেকদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছবি দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে একুশের ডাক টিকেট যুক্তরাষ্ট্রে চালু করার জন্যে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি দিয়ে একুশের এই ডাক টিকেট যে কোন ভিনদেশীর হাতে পাওয়া মানে- বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন আর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন সম্পর্কে জানার বিষয় বিদেশীদের কাছে আগ্রহী করে তোলা। আমাকেও যখন প্রথম প্রস্তাবটি দেয়া হয় তখন একই শর্ত দেয়া হয় যা অনেকটা সেই সময় অসম্ভব ছিল। যে সময় আমি আবেদন করেছিলাম ‘মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে আমেরিকাতে ডাক টিকেট চালু করার একটি প্রস্তাব দেয়া হয় ‘ইউএস পোস্টাল সার্ভিস সিটিজেন এ্যাডভাইজারি বোর্ড ’-এর কাছে। আর যে সময়টিতে এই প্রস্তাবটি দেয়া হয় সে সময় আমাদের মাতৃভাষা দিবস তখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। বোর্ড জানাল আপাতত কোন অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত ভাষা দিবসের ডাক টিকেট চালু করা সম্ভব নয় বলে আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো। তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম যদি কোন নতুন নিয়ম চালু হয় যা আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছবি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ডাক টিকেট চালু করা যেতে পারে। পট পরিবর্তন হয়ে বাংলাদেশের ‘শহীদ দিবস’ স্বীকৃতি পেল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। আমার জন্যে বোর্ডকে অনুমোদনের পক্ষে অনেকটা অনুকূলে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ মর্যাদা লাভের কারণে। পুনরায় আবেদন করা হলো ‘ইউএস পোস্টাল সার্ভিস সিটিজেন এ্যাডভাইজারি বোর্ড’-এর কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দিয়ে ডাক টিকেট চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্যে। আবেদনের সঙ্গে আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দিয়ে বেশ কয়েকটি ডিজাইন দেয়া হলো। সেসঙ্গে ডাক টিকেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছবির প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি ছোটখাটো ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছিল। এতে বলা হলো ‘পৃথিবীতে ভাষার জন্যে কোন দেশ যদি প্রাণ দিয়ে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে- একমাত্র দেশ ‘বাংলাদেশ’। আর এর মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। অতএব একুশের এই ডাক টিকেটে ঢাকার শহীদ মিনারের ছবির যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি দিয়ে একুশের এই ডাক টিকেট যে কোন ভিনদেশীর হাতে পাওয়া মানে- বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন আর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন সম্পর্কে জানার বিষয় বিদেশীদের কাছে আগ্রহী করে তোলা- এটাই ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দিয়ে ডাক টিকেট যুক্তরাষ্ট্রে চালু করার মূলমন্ত্র। কিন্তু এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ডাক সরবরাহে ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ভোক্তাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে ৩টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হলো ‘অনলাইন ইউএস পোস্ট অফিস অনুমোদিত ডাক টিকেট ‘চালু করতে পারবে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজাইন ও বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ করবে যেটা যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে সংরক্ষণ করবে। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এর ফলে কোন প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি তাদের পছন্দনীয় ডিজাইন জমা দিয়ে ডাক টিকেট পেতে পারে। পরে ডিজাইন অনুমোদিত হলে ডাক টিকেট পেতে পারবে। আর তাই আমার স্বপ্নের একুশের ডাক টিকেট কোন ধরনের জটিলতার সম্মুখীন না হয়ে ‘ঢাকার শহীদ মিনারের ছবি’ দিয়ে একুশের ডাক টিকেটের অনুমোদন পেলাম সে অনুভূতির কথা আমি বলে বোঝাতে পারব না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয়েছিল ২০০৮ সালে ‘ইউএস পোস্ট অফিস’ অনুমোদিত প্রথম অনলাইন ‘একুশের ডাক টিকেট’ (http:/ww/w.yayyle.com/ekusheystamp)। ৩১ জানুয়ারি, ২০০৮ সালে লস এঞ্জেলেস শহরে এক ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে আমাদের ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছবি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম অনলাইন ‘একুশের ডাক টিকেট’ চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একুশের ডাক টিকেট চালু করার বিষয়টি ছিল আমার একটি লুকায়িত স্বপ্ন। ২০০৮ সালে এই ডাক টিকেট চালু করার কথা শুনে দেশে এবং বিদেশ থেকে প্রচুর ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। রেডিও, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকাতে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশগুলোতে বেশ আলোচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে একুশের অনলাইন ডাক টিকেট চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর সাড়া ও ই-মেইলে মন্তব্য পেয়েছি। এর মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নাদিয়া লিখেছেন যে, তিনি তার বিয়ের দাওয়াতের জন্য ২০০-এর অধিক একুশের ডাক টিকেট ব্যবহার করেছিলেন এবং তার পরিবারের সবাই একুশের ডাক টিকেটসহ বাড়িতে নিমন্ত্রণপত্র দেখে অবাক এবং খুব খুশি। যুক্তরাষ্ট্রের পোস্ট অফিস অনুমোদিত একুশের এই ডাক টিকেট ব্যক্তিগত অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ডাক বিতরণের কাজে ব্যবহার করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় ডাকঘর থেকে আমাদের ঐতিহাসিক ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ছবি দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ডাক টিকেট প্রকাশ করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস সিটিজেন স্ট্যাম্প এ্যাডভাইজারি বোর্ড’-এর কাছে একটি আবেদন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী [email protected]
×