ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

শেখ হাসিনার ‘ঔদ্ধত্য’ ॥ মাহফুজ আনামের উপলব্ধি

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শেখ হাসিনার ‘ঔদ্ধত্য’ ॥ মাহফুজ আনামের উপলব্ধি

কয়েকদিন থেকে প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের চৌকস সম্পাদক মাহফুজ আনাম আলোচনা-সমালোচনায় শীর্ষে। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির বিষয়ে তার পত্রিকায় একাধিক রিপোর্ট ছাপা হয়। অনুমাননির্ভর এবং যাচাই-বাছাইবিহীন এসব গুরুতর অভিযোগের কোনটাই প্রমাণিত হয়নি। সম্ভবত সেই মনস্তাপে সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার ভুল স্বীকার করেছেন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রুজু হয়েছে। একটিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। রাজনীতির বড় এবং পাকা খেলোয়াড় মাহফুজ আনাম ২০০৭-০৮ সরকারকে ক্ষমতায় আনার একজন নেপথ্যের নায়ক বলেই সকলে জানছেন। সেই সরকারের আমলে মাইনাস টু মতান্তরে মাইনাস ওয়ান নাটকের রূপায়নে সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতেই হয়তবা মাহফুজ আনাম অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এটা রাজনীতির খেলা। এতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা দেখছি না। তবে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে সেটা আলাদা কথা। ২০০৭-০৮ মেয়াদে কেয়ারটেকার সরকারের ক্ষমতায় আরোহণের প্রস্তুতিপর্বে সিপিডি, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সক্রিয় উদ্যোগে ২০ মার্চ ২০০৬ তারিখে তদানীন্তন শেরাটন হোটেলে সিভিল সোসাইটি সিটিজেনস গ্রুপ গঠন করে। উদ্দেশ্য নির্বাচনে ’সৎ প্রার্থী’ মনোনয়ন দেয়া। দেশে তখন ভয়ানক অস্থিরতা, দুর্নীতি, খুন-খারাবি, স্বেচ্ছাচার এবং অরাজকতা। একটি যেনতেন নির্বাচন প্রহসনে ফের সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে পুতুল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। চলমান থাকে দুর্বার গণআন্দোলন। বিরোধী দল গড়ে তোলে জনতার ঐক্য একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সপক্ষে। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখে জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস একটি খোলা চিঠিতে একটি দল ঘোষণার প্রস্তাব দেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নাগরিক শক্তি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসে। কানাঘুষা ছিল জনাব মাহফুজ আনাম ওই দলের মহাসচিব হচ্ছেন; আমি কখনই এতে কান দিইনি। ইতোমধ্যে কেয়ারটেকার সরকার দুর্বল প্রশাসনে দুর্নীতি দমনের নামে কথিত দুর্নীতিবাজদের কয়েকটি তালিকা প্রকাশ করে। অনেকে গ্রেফতার হন দুর্নীতির মামলায় কোন রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া। দ্য ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকায় শেখ হাসিনার কথিত দুর্নীতির কয়েকটি কল্পকাহিনী ছাপা হয়। এর মধ্যে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুল জলিল, নূর আলী, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের আজম জে চৌধুরী এবং ওয়েস্ট মন্ট গ্রুপের তাজুল ইসলাম ফারুকের প্রসঙ্গ উঠে আসে। সবচেয়ে হাস্যকর মজাদার কাহিনী : তাজুল ইসলাম ফারুক দাবি করেন যে, তিনি নগদে পৌনে তিন কোটি টাকা স্যুটকেসে নিজে বহন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণভবনে দিয়ে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালে। উঠে আসে রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কথা এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জঅঞঝ নিয়ে রটনা ঘটনা আলোচনা। টার্গেট কিন্তু শেখ হাসিনা; অন্তত ডেইলি স্টার, প্রথম আলোর পাতায় তাই ফুটে ওঠে। অতঃপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন। দেশ-বিদেশে নন্দিত এই সুষ্ঠু নির্বাচনে শেখ হাসিনা; আওয়ামী লীগ ও ১৫ দলীয় জোট বিপুল ভোটে এবং তিন-চতুর্থাংশ সংসদীয় আসন নিয়ে বিজয়ী হন। শুরু হয় অভূতপূর্ব অগ্রগতির সোপানে বলিষ্ঠ জয়যাত্রা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানে দেশ এগিয়ে চলে। বিদ্যুত সমস্যার সমাধান, কৃষিক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি, শিক্ষায় নজিরবিহীন উন্নতি, গ্রামবাংলায় উন্নয়নের ঢেউ, দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্য, শিল্পায়নে অগ্রসরতা, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট, সমুদ্র বিজয় এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য- সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে আজ বিশ্ব আসনে অত্যন্ত সম্মানের স্থানে। শেখ হাসিনা পেলেন চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ পুরস্কার, বরিত হলেন বিশ্বের তেরোতম সর্বোচ্চ চিন্তাবিদের আসনে। এর মাঝেও তার ব্যর্থতা আছে; একটি হলো যারা তার বৈরী তিনি তাদের মন জয় করতে পারলেন না। ২৭ জুন ২০১৩ তারিখে মাহফুজ আনাম তার নিজ নামে লিখিত সংবাদ বিশ্লেষণে ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় লিখলেন, ‘অৎৎড়মধহপব, যিরসং, াবহমবধহপব’ লক্ষ্য শেখ হাসিনা। ওই বিশ্লেষণে দুটো মূল প্রতিপাদ্য : কেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরকার সরিয়ে দিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ এবং তদধীনে প্রণীত বিধিমালায় পরিষ্কারভাবে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার বিধান লিপিবদ্ধ। সে কারণেই উচ্চতর ন্যায়ালয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার রুজু করা মামলায় হেরে গেলেন। উষ্মার দ্বিতীয় কারণ পদ্মা সেতু- কেন শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অনুশাসনে (অন্যায় এবং ভুল প্রমাণিত) মাথা নত না করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহস দেখালেন। এখন অবশ্য বিশ্বব্যাংকও বুঝতে পেরেছে যে, তারা মাটি খাওয়া কাজ করেছে, তাই সখ্য করার চেষ্টারত। আর পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৮ সালের মধ্যেই সমাপ্ত হয়ে দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পালে দ্বিগুণ হাওয়া যোগাবে। লেখক : সাবেক গবর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
×