ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেলফিতে প্রেমময় বসন্ত

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো...

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো...

মোরসালিন মিজান ॥ তোমার গোপন কথাটি, সখী রেখো না মনে।/শুধু আমায়, বলো আমায় গোপনে...। হৃদয়ের একান্ত গোপন কথাটি বলার সময় এসেছে। আজ দ্বিধা নয় কোন, প্রিয়জনকে দিব্যি বলে দেয়া যাবে ‘ভালবাসি’! খুব যে লাজুক মেয়ে, সেও মুখ খুলবে আজ। প্রিয়জনের কাছে জানতে চাইবে, উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন? হ্যাঁ, পশ্চিমা সংস্কৃতি। কিন্তু ভালবাসা যে! অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ভালবাসার তো কোন পুব পশ্চিম হয় না। তাই পাশ্চাত্যের ঢেউ এসে আচড়ে পড়ছে বাংলাদেশে। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার ভ্যালেন্টাইন ডে। বিশ্ব ভালবাসা দিবস। কিউপিডের তীরে হৃদয় বিদ্ধ হওয়ার দিন। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি উদযাপিত হবে। আজ ভালবাসার লাল রঙে নিজেকে বদলে নেবে শহর। পোশাকে স্থান করে নেবে লাল। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় উঠবে লাল গোলাপ। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেবেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবহার করে চলবে ভালবাসার আদান প্রদান। ভ্যালেন্টাইন ডে একদিন মাত্র। একদিনের বটে। উস্কে দেয় প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের প্রেম। হৃদয়কে জাগিয়ে দেয়। আজ শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার দিন। ভালবাসার মহা অনুভূতির কাছে নিজেকে নিশ্চিন্তে সঁপে দেয়ার উপযুক্ত সময়। ভালবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে আজ বাঙালী। হাসন রাজার ভাষায়- নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে...। ভাটি বাংলার এই লোককবির নিশা আর কাটেনি কোন দিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুর তোলেন- ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে...। এ আগুনকে দ্বিগুণ করতে আবারও এসেছে ভালবাসার বিশেষ দিবস। আজ ঘরে থাকা দায়। রাধার মন থেকে বললে, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না...।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের। তার বলাটি- আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া...। মনের মানুষটি ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালবাসার জন্য। প্রথম দিকে দিবসটি ঘিরে কিছুটা ফিস ফিস ছিল। এখন আর তা নেই। বিপুল আবেগ উচ্ছলতায় কাটে বিশেষ এই দিবস। ভালবাসার দিবসে নতুন করে দেখা দেয় চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে যুগল। শহর ঘুরে বেড়াবে। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে- নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙ্গুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলঙ্কার করে নাও, এ আঙ্গুল ছলনা জানে না...। প্রিয়জনের হৃদয়ে চিরকাল বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলবে- ভালবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/ মনের মন্দিরে। প্রেমের কবি নজরুল তো প্রিয়ার চোখেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। গেয়েছিলেন- চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে...। আজ সারা জীবন প্রিয় মানুষটির পাশে থাকার শপথ নেয়ার দিন। নজরুলের ভাষায়- এসো তুমি একেবারে প্রাণের পাশে।/ যাও মিশে গো আমার প্রাণে, আমার শ্বাসে...। আর যারা একলা মানুষ তাঁরা মনের মানুষটিকে ‘ভালবাসি’ বলার সব চেষ্টা করবেন। পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেয়েদের প্রশ্নটি হবে- উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন? যারা সাহস করতে পারবেন না তারা অপেক্ষা করে থাকবেন, হঠাৎ কিছুর জন্য। গুন গুন করে গাইবেন- হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে-/ এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরাণ চমকি তোলো...। কারও কারও ভেতরে ভালবাসার সকল অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কার জন্য ব্যাকুল মন সেটি আর বোঝা হয় না। কবিগুরুর ভাষায়- যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/ কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম...। আর যারা নামটি জানেন কিন্তু তাকে বলতে পারেন না ভালবাসি সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে কবিগুরু বলেছিলেন- আমি যে আর সইতে পারি নে।/ সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে। অন্যভাবে বললে- লাগে বুকে সুখে-দুঃখে কত যে ব্যথা,/কেমনে বোঝায়ে কব না জানি কথা...। এখানেই শেষ নয়। ভ্যালেন্টাইস ডে মনের পুরনো অনেক ব্যথা জাগিয়ে তুলবে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘ঝরা ফুল’ কুড়াবেন অনেকে। নজরুল থেকে বলবেন- বলেছিলে তুমি ভালবেসে মোরে, মোর হাতখানি ধরে।/ সেই দুটি কথা ভুলিতে পারি না, নিশিদিন মনে পড়ে...। অবশ্য এখন স্থূল প্রেমও কম নয়। তরুণ-তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছে এবং বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছে-ব্রেকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভালবাসাবাসি! তবে আজ এসব প্রেমের কথা হবে না। সুন্দর শ্রেষ্ঠ প্রেমগুলোর বার বার স্মরণ করবে মানুষ। আজ সবটুকু সততা নিয়ে একে অন্যকে বলবেন ‘এভরি থিং আই ডু আই ডু ইট ফর ইউ। শিরি- ফরহাদ, লাইলী- মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রোমিও-জুলিয়েটের মতো অমর হওয়ার স্বপ্নে উদযাপিত হবে ভ্যালেন্টাইনস ডে। যতদূর তথ্য, এই ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবী জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা-সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় বেশকিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনও কখনও ওই দুজনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এ রকম-সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হচ্ছে না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
×