ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যর্পণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যর্পণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন

(১ ফেব্রুয়ারির চতুরঙ্গ পাতার পর, শেষাংশ) তাদের সে আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল না। তা ছিল এতদাঞ্চলের মুসলিম উন্নয়নবিরোধী হিংসাত্মক আন্দোলন। ... জনমতকে উপেক্ষা করে একজন বিতর্কিত ও মুসলমান বিদ্বেষী মহিলার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের নামকরণ উদ্দেশ্যমূলক।” এই সব আইনজীবীদের সনদ প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম না, আওয়ামী লীগাররা তাদের মিত্রদের ব্যাপারে যত কঠোর শত্রুর বিরুদ্ধে ততই নমনীয়। বঙ্গভঙ্গের সময় প্রীতিলতার জন্মই হয়নি। প্রয়াত আযিযুল হককে পত্রিকা অলা আর ঐ সব ফ্রন্টের লোকজন ‘শায়খুল হাদিস’ বলত। সেই আযিযুল বলেছিলেন- “মানুষের পক্ষে চাঁদে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কোন দেশ থেকে ঘুরে এসে তারা দাবি করছে চাঁদে দেখেছি। আর মঙ্গলগ্রহে যাওয়া পিকনিকের মতো ব্যাপার। চেষ্টা করলে আমরাও যাইতে পারি। তাছাড়া ঐখানে গিয়া কি অইবো? শুধু শুধু টাকা পয়সা নষ্ট।” [মোহাম্মদ মোর্তজার সঙ্গে সাক্ষাৎকার, বিচিত্রা, ১৯৯৭]। ॥ তিন ॥ খালেদা জিয়া যে এই প্রথম শহীদদের নিয়ে বিতর্ক শুরু করলেন তা নয়। তিনি তার স্বামীর রাজনীতিতে আসার পর থেকেই বাঙালীদের অপমান করার পথ বেছে নিয়েছেন। দুটি উদাহরণ দিই। ১. ১৫ আগস্টকে পাকিস্তানীরা বলে নাজাত দিবস। ঐ দিন তারা ‘জালেমের’ হাত থেকে ‘মুক্তি’ পেয়েছে বিধায় ‘নাচগান হৈহুল্লোড় করে, কাঙ্গালি ভোজ দেয়, মিষ্টি টিষ্টি, হুইস্কি খায়। খালেদা ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করেন। এর চেয়ে বড় অপমান বাঙালীকে কেউ করেনি। বাঙালী তো আর সেই বাঙালী নেই, অধিকাংশই তৃতীয় লিঙ্গতে পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে। নয়ত ঐ জন্মদিন পালন উৎসবেই আগুন লাগিয়ে দিত। ২. জেনারেল জ্যাকব ছিলেন বাঙালীদের বন্ধু। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি নিয়াজীকে বাধ্য করেছিলেন আত্মসমর্পণে। আত্মসমর্পণের দলিলটিও তাঁর লেখা। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি শোক জানিয়েছেন। জানান নাই খালেদা। ‘টাইগার’ নিয়াজীর বিল্লি নিয়াজী হয়ে যাওয়া তিনি মানতে পারেননি। সেই জ্যাকবের মৃত্যুতে খালেদা বা তার ল্যাঙ্গটরা বা তার বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতারা কোন শোকবার্তা পাঠাননি বা শোক জানাননি। কিন্তু তাকে যে পাকি জেনারেল আটকে রেখেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, সেই জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এটি শুনে দেখে নূরজাহানের গানের একটি কলি মনে পড়ছে- দিল দিলই তো হ্যায়, পাথরতো নেহি। খালেদা, গয়েশ্বর গং যে হঠাৎ করে শহীদ নিয়ে বিতর্ক তুলছেন তা নয়। খুব ভেবেচিন্তেই প্রসঙ্গটি উঠিয়েছেন। বাস্তব পরিস্থিতি এখন তারা অনেকটা বুঝতে পারছেন। তারা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ক্ষমতায় না গেলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটিই এখন রাজনীতির প্রশ্ন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবনয়ন হচ্ছে। এমনও হতে পারে এটি কনসাল পর্যায়ে চলে আসতে পারে। যে পাকিস্তান তাদের এখন রসদ যোগাচ্ছে তারা না থাকলে এরা এতিম হয়ে যাবে। তারা প্রভুদের বোঝাতে চাচ্ছে, আমরা তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না। সাময়িকভাবে পাকিস্তানী যারা গুটিয়ে গিয়েছিল তাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ যদি ৩০ লাখ না মেনে নেয় তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশের আইনগত ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। তাহলে তো কেল্লাফতে। চাঁদ-তারা খচিত নিশান নিয়ে পথে নেমে পড়া যাবে। আমার মতে, ৩০ লাখ নিয়ে কু-বিতর্কে যাওয়ার দরকার নেই। ৩০ লাখ ছিল সেটিই থাকবে। যারা মানবে না তাদের নিয়ে কি করা যায় সেটিই এখন আলোচ্য বিষয়। ৩০ লাখের যৌক্তিকতা প্রমাণেরও দরকার নেই, ঐতিহাসিক সত্যের আবার যৌক্তিকতা প্রমাণ কী? চোর কখনও ধর্মের কাহিনী শোনে না। বিএনপি-জামায়াত সুস্থ রাজনীতির পক্ষে নয়। অপরাজনীতির পক্ষে। অপরাজনীতি না করলে যুক্তি-তর্ক সম্ভব। দেখেন, এখন শমসের মবিন চৌধুরী কত ভদ্রলোকের মতো যুক্তিসঙ্গত কথা বলছেন। এক বছর আগে এটি সম্ভব ছিল? যুক্তি বা রাজনৈতিক প্রতিরোধ এখন আর তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একমাত্র প্রযোজ্য পথেঘাটে বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ। ১৯৭২-৭৪ সালে এসব কথা বলার পর কেউ রাস্তায় নামতে পারত! সে কারণেই নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি কতগুলো দাবি দেয়া হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম- মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন। ইউরোপেও বাধ্য হয়ে এ আইন করা হয়েছে। এখন এদেশে পাকিস্তানীদের উৎপাত এতো বেড়েছে যে এ ছাড়া উপায় নেই। নির্মূল কমিটি সব সময় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে। তাদের পেশকৃত দাবিতে পাকিস্তানায়ন রোধ করার কথা বলা হয়েছে। নির্মূল কমিটির সাধারণ কর্মী হিসেবে কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবিরসহ অন্যদের কাছে আরও কয়েকটি অনুরোধ রাখতে চাই- ১. বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানীরা অনেকগুলো ছিটমহল গড়ে তুলছে। এসব ছিটমহল বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য আন্দোলন করা যায় কি-না বা কী ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায়? নির্মূল কমিটি ছাড়া অন্য কোন গ্রুপের পক্ষে সরাসরি আটকেপড়া পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বলা বা নামা প্রায় সম্ভব নয়। কারণ, ব্যবসা, আত্মীয়তা, বন্ধুত্বের সূত্রে আটকেপড়া পাকিস্তানীদের সঙ্গে তারা থাকতে বাধ্য। ২. যতদিন মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন সরকার না করছে ততদিন আটকেপড়া পাকিস্তানীদের পাকিস্তানে ফেরত নেয়ার জন্য আন্দোলন করা। সরকার যেন প্রশাসন ও দলে পাকিস্তানবান্ধবদের ঘের কেটে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও পাকিস্তানের কাছে এ দাবি জোরালোভাবে তোলে সেজন্য আন্দোলন সমাবেশ করা। ৩. বিএনপি-জামায়াত বা আটকেপড়া পাকিস্তানীদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে কিন্তু আদর্শগত দ্বন্দ্ব নেই। সুতরাং, নির্মূল কমিটি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুললে বিএনপি বা তাদের ফ্রন্টের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি কেন তুলছে না বা সরকারের কাছে দাবি জানাবে না? ৪. না বুঝে যেসব সিøপারকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ বা উপাধি দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেন কিছু বলা হবে না? তাদের সনদ, উপাধি কেন প্রত্যাহার করা হবে না? এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক জোটের নেতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ কী বলেন? তাকে অনেক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে শুনি কিন্তু এসব ব্যাপারে নিশ্চুপ। আমি নেতাদের কাছে জানতে চাই, নিজের বিভ্রম দূর করার জন্যÑ যদি ১৯৭১-এর অপরাধীদের বিচার হয় [যা হচ্ছে] এবং যদি কোন সনদধারী/উপাধিধারী মুক্তিযোদ্ধা তা সমর্থন করে বা যে দল এর বিরোধী সে দল করে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধার বৈশিষ্ট্য তার থাকে কিনা? বা সেও অপরাধী হয় কিনা? দেশের সর্বোচ্চ উপাধি এসব লোককে দেয়া যায় কিনা? এতে দেশের বা শহীদদের অবমাননা হয় কিনা? খালেদা ৩০ লাখ নিয়ে প্রশ্ন তুললে যদি অবমাননা হয় মুক্তিযুদ্ধের, তাহলে একজন হাফিজ বা ওমর তা সমর্থন করলে একই অপরাধ হয় কিনা? আসলে নিজেদের বিভ্রম কাটানোর জন্য এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরী। বিভ্রম নিয়ে আন্দোলন করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। তবে আপাতত মনে করি, আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যর্পণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।
×