ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পে স্কেলে বৈষম্যের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন ১৫ সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা

কর্মবিরতিতে অচল সারাদেশের ৩১০ সরকারী কলেজ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

কর্মবিরতিতে অচল সারাদেশের ৩১০ সরকারী কলেজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পে স্কেলে বৈষম্য সৃষ্টি, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের প্রতিবাদে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়েছে সারাদেশের ৩১০ সরকারী কলেজ, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের কর্মবিরতি শুরু করেছেন সরকারী কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা, টিটি কলেজ, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, শিক্ষাবোর্ড ও অধিদফতরে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষক-কর্মকর্তা। কর্মবিরতির কারণে প্রথম দিনই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকার সরকারী কলেজে কোন ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সকাল থেকে কলেজ চত্বরে মানববন্ধন ও কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। প্রথম দিনের কমসূচীতে শিক্ষকরা আগামী এক মাস কয়েক দফা আন্দোলনের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নাসরীন বেগম ও মহাসচিব আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেছেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দেশের সব সরকারী কলেজের শিক্ষকরা ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পূর্ণ দিবস কর্মবিরতিতে থাকবেন। নয় মাস ধরে সমস্যা তুলে ধরা হলেও দাবি পূরণে কোন অগ্রগতি হয়নি জানিয়ে তারা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের ঘোষিত কর্মসূচী চালিয়ে যাব। ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আলোচনা বা সমঝোতার সুযোগ আছে। ফলপ্রসূ অগ্রগতি না হলে ৬ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবার ক্লাস বর্জন। এতেও দাবি আদায় না হলে ১১ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচী পালন করা হবে। সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনসহ অনির্দিষ্টকালের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি শুরু করা হবে। এর আগে ২২ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বেতনবৈষম্য নিরসন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের জন্য সরকারকে চূড়ান্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন শিক্ষকরা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ৪ ও ৫ জানুয়ারি পূর্ণদিবস কর্মবিরতিরও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সংবাদ সম্মেলন থেকে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী দুদিন কর্মবিরতি পালন করা হয়। এরপর গেল ২২ জানুয়ারি সমিতির সাধারণ সভায় এক কর্মবিরতিসহ মাসব্যাপী নানা প্রতিবাদ কর্মসূচীর ডাক দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারী কলেজগুলো ছাড়াও আন্দোলনের আওতায় ১৪টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটিসি), ১৬টি সরকারী কমার্শিয়াল কলেজ ও চারটি সরকারী মাদ্রাসা-ই-আলিয়া রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ আছে ১৫ হাজার ২৪৬টি। এর মধ্যে অধ্যাপকের পদ ৬৩৪টি, সহযোগী অধ্যাপক দুই হাজার ৪০৩টি, সহকারী অধ্যাপক চার হাজার ২১৪টি ও প্রভাষকের পদ সাত হাজার ৯৯৫টি। মঙ্গলবার বিভিন্ন সরকারী কলেজে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছেন শিক্ষকরা। বেতনবৈষম্য নিরসন ও মর্যাদা ফিরে আনার দাবিতে ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির শিক্ষকরা। কর্মসূচী থেকে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আলাদা বেতন স্কেল নয়, বর্তমান বেতন কাঠামোতেই সকল স্তরে বেতনবৈষম্য নিরসন সম্ভব। এটা শিক্ষকদের মর্যাদার প্রশ্ন। বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে আসার কোন পথ নেই। অবিলম্বে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পুনর্বহাল করে বৈষম্য নিরসন ছাড়া শিক্ষকদের অসন্তোষ কমবে না। শিক্ষক নেতারা দাবি পূরণে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, বর্তমান সরকার সম্প্রতি জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা করেছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। পে স্কেলের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক পদে বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিকে বিবেচনায় না এনে অধ্যাপক পদের বেতন স্কেল ও গ্রেড অবনমন করা হয়েছে। সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাতিল করে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকসহ শিক্ষা ক্যাডারের সকল স্তরের বেতনবৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজার সদস্য এটি উপভোগ করতে পারছে না। বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকরা তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে বলেছেন, এখনও বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড হতে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হন। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপকরা পঞ্চম গ্রেড হতে চতুর্থ গ্রেডে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান, যা বৈষম্যমূলক। পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় শিক্ষা ক্যাডারের অনেকেই সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান। সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল না থাকায় এখন সহযোগী অধ্যাপকদের পঞ্চম গ্রেড হতে অবসরে যেতে হবে। প্রাপ্য মর্যাদায় উন্নীত না করে স্কেল ও পদ অবনমনে শিক্ষকরা মর্মাহত। শিক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, পদ ও স্কেল অবনমনের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ চতুর্থ গ্রেডে নির্দিষ্ট করে, শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন অধিদফতর ও শিক্ষা প্রকল্পের তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম গ্রেডে অন্য ক্যাডার হতে পদায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সকল সরকারী কলেজেও তিন দিনের কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ২০টি সরকারী কলেজের শিক্ষকরা কর্মবিরতির পাশাপাশি সমাবেশও করেছেন। নগরীর চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজ, সরকারী কমার্স কলেজ, সিটি কলেজ ও নাসিরাবাদ সরকারী মহিলা কলেজে কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকরা। এছাড়া গাছবাড়িয়া সরকারী কলেজ, পটিয়া কলেজ, কক্সবাজার সরকারী কলেজ, কক্সবাজার মহিলা কলেজ ও তিন পার্বত্য জেলার কলেজগুলোতেও কর্মসূচী পালনের খবর পাওয়া গেছে। কর্মসূচী চলাকালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন, সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার মধ্য দিয়ে সরকারী কলেজ শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তা কোন অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। সিলেকশন গ্রেড না থাকায় অধ্যাপকরা চতুর্থ গ্রেড থেকে অবসরে যাবেন, এতে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা উচ্চপদগুলোতে আসবেন। এটি শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। তারা আরও বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সদ্যঘোষিত পে স্কেলে ইচ্ছাকৃতভাবে এ বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন। পে স্কেল ঘোষণার পর আমাদের বেতন বেড়েছে, কিন্তু মর্যাদা কমেছে। এ জন্য এত সুন্দর পে স্কেল পাওয়ার পরও শিক্ষকরা খুশি হতে পারছেন না। এ জন্য আমরা কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচী পালন করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। সরকারী সিটি কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন, আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আগের পদমর্যাদা থেকে আমাদের অবনমন করা হয়েছে। নতুন স্কেলে বেতন বাড়লেও সেটা আমরা উপভোগ করতে পারছি না। কারণ এটা আমাদের সম্মানের প্রশ্ন। আশা করি, সরকারও আমাদের দাবি মেনে নেবে। সাতক্ষীরার চারটি সরকারী কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আহ্বানে সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন তারা। জেলার সাতক্ষীরা সরকারী কলেজ, সাতক্ষীরা সরকারী মহিলা কলেজ, কলারোয়া সরকারী কলেজ ও তালা সরকারী কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা এলেও শ্রেণীকক্ষে যাচ্ছেন না শিক্ষকরা। দাবি আদায় না হলেÑ আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে জানান তারা। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আন্দোলন শুরু করেছেন পাবনার ছয়টি সরকারী কলেজের শিক্ষকেরা। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ ইউনিটের উদ্যোগে কর্মসূচীর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সকাল থেকে কলেজ চত্বরে মানববন্ধন ও কর্মবিরতি পালন করা হয়। কর্মসূচীতে সরকারী শহীদ বুলবুল কলেজ, সরকারী মহিলা কলেজ, সরকারী কমার্শিয়াল কলেজ, সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (টিটিসি) ও ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের শিক্ষকরা অংশ নেন। এমপিওভুক্তি শিক্ষকদের বিষয়ে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের বিবৃতি ॥ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু এক বিবৃতিতে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন নিয়ে বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্ত সৃষ্টির অপচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনের সঙ্গে মার্চ মাস থেকে এরিয়ারসহ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন স্কেলে বেতন পাবেন। এ ছাড়াও শিক্ষাবান্ধব বর্তমান সরকার বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বাড়ি ভাড়া পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা তিন শ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করায় সরকারকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। বিবৃতিতে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, বর্তমান শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সর্বদা শিক্ষা ও শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। তারা মহল বিশেষ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান।
×