ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

জিজ্ঞাসাবাদে রিমান্ডে নেয়া ১৪ জনের তথ্য ;###;বিদেশে জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন এক শীর্ষ শিল্পপতি ও এক সচিবের ছেলেসহ ৫ জন

সিঙ্গাপুর থেকে ওরা টাকা পাঠাত জঙ্গী তৎপরতার জন্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

সিঙ্গাপুর থেকে ওরা টাকা পাঠাত জঙ্গী তৎপরতার জন্য

শংকর কুমার দে ॥ সিঙ্গাপুরে জঙ্গী সম্পৃক্ততায় গ্রেফতার হওয়া ২৭ জনের মধ্যে যে ২৬ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা সেদেশে আর কোনদিন যেতে পারবে না, ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’। ফেরত ওই ২৬ জন মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের বাইরেও যেতে পারবে না। ‘নিষেধাজ্ঞা জারি’ করা হয়েছে। এ জন্য বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় তাদের ছবি ও বায়োডাটাসহ পরিচিতি পাঠানো হয়েছে। ফেরত পাঠানো ২৬ জনের মধ্যে ১২ জনকে পারিবারিক জিম্মায় দেয়া হলেও তারা আছেন নজরদারিতে। অপর ১৪জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা অব্যাহত আছে, তারা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। কিন্তু ইসলামিক স্টেটস (আইএস) বা আল কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছেন, জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন পাঁচ জনের নাম বলেছেন যাদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতির ছেলে, একজন সচিবের ছেলে রয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানান, সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগে ওই ২৬ জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীর কারামুক্ত, হেফাজতের সমাবেশের জন্য, মসজিদ, মাদ্রাসার জন্য টাকা পাঠিয়েছে। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মার্কেটের পাশে এ্যাঙ্গলিয়া নামক যেই মসজিদে নামাজ পড়ত, সব ধরনের বয়ান, জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিষয়ে মসজিদের সামনে একটি নোটিস বোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। যে ২৬ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা দুই থেকে আট বছর ধরে সিঙ্গাপুরে কাজ করছিল। তারা নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করার সময়ে নিয়মিত এ্যাঙ্গলিয়া মসজিদে তারা নামাজ পড়তে আসার ফাঁকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামক জঙ্গী সংগঠনের সম্পৃক্ততায় জড়িয়ে পড়েন। তাদের মোবাইল ফোনে জঙ্গী সংশ্লিষ্ট ভিডিও, ছবি, ওয়াজ, বয়ান ও বাসায় জিহাদী বই পাওয়ার দাবি করে সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে নেয়া ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে পাওয়া গেছে, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতির ছেলে ও একজন সচিবের ছেলে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তারাসহ পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করেছেন গ্রেফতারকৃতরা। ইসলামী ব্যাংকের একজন ফাউন্ডার পরিচালক যার নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম তারই এক নিকটাত্মীয় মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী দুই ছেলের একজন। অপর একজন যিনি দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল পদ মর্যাদার সামরিক কর্মকর্তার নিকটাত্মীয় বলে জানতে পেরেছেন ডিবির তদন্তকারীরা। এসব তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে দেশের ভেতরে বড় ধরনের জঙ্গী তৎপরতার ভিত তৈরি হয়ে বড় ধরনের নাশকতা ঘটানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডিবির তদন্তকারীরা প্রাপ্ত তথ্য খতিয়ে দেখছেন। যা বলেছেন ডিএমপি পুলিশ ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ২৭ বাংলাদেশীর সঙ্গে জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও আইএস’র কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ২৭ জনের মধ্যে ১৪ জন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের মতাদর্শে বিশ্বাসী। এই ১৪ জন সিঙ্গাপুরের এ্যাঙ্গলিয়া নামে একটি মসজিদে প্রায়ই একত্রিত হতেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমপি মুখপাত্র। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের নবেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মোট ২৭ জনকে ব্ল্যাক লিস্টেড করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর সরকার। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মধ্যে ১৪ জনের সঙ্গে জঙ্গীদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তারা আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানিয়ার অনুসারী এবং মূলত জসীমউদ্দিন রাহমানিয়ার মুক্তির জন্য কাজ করছিল। গ্রেফতার ১৪ জনের মধ্যে কয়েকজনের মোবাইল ফোন থেকে জসীমউদ্দিন রাহমানিয়ার বইয়ের সফটকপি পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। যাদের ওয়াজ, বয়ান, বক্তৃতা শুনত ॥ সিঙ্গাপুর পুলিশ ২৬ জনের জঙ্গী সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পেরে তাদের আটক করে। তাদের বাসা তল্লাশি করে মোবাইল ফোন জব্দ করে। তাদের মোবাইলে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানী, ড. জাকির নায়েক, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, শায়েখ মতিউর রহমান মাদানী, আমান উল্লাহ বিন ইসমাইল এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর ওয়াজ পাওয়া গেছে। তারা ‘লা-মাযহাব’, অর্থাৎ কোন মাজহাব অনুসরণ করে না। তারা জসীমউদ্দিন রাহমানী, আবুল কালাম, ড. জাকির নায়েক প্রমুখ ব্যক্তিদের বক্তৃতা শুনে আহলে হাদিসের অনুসারী হন। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ॥ ডিবির তদন্তকারীর জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের সহযোগিতার কথা বলে এবং মসজিদ মাদ্রাসার নামে তারা নিয়মিত চাঁদা ওঠাত। এই টাকা তারা বাংলাদেশে জিহাদী বই প্রকাশের জন্য পাঠাত। এদের মধ্যে বৈঠকে নিয়মিত বয়ান করত আমিনুর, নুরুল হক ও আশরাফ। বয়ানে তারা জিহাদ, আল্লাহর রাস্তায় আত্মোৎসর্গ করা এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে উদ্বুব্ধ করত সদস্যদের। বাংলাদেশ থেকেও আনসারুল্লাহর নেতারা তাদের জিহাদী কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতেন। এই প্রথম বারের মতো সিঙ্গাপুর ছাড়া এর আগে বিদেশের আর কোন দেশ থেকে জঙ্গী সম্পৃক্তায় বাংলাদেশের নাগরিককে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটেনি।
×