ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কম্যুনিস্ট জুজুর পর কি জিহাদিস্ট জুজু ?

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

কম্যুনিস্ট জুজুর পর কি জিহাদিস্ট জুজু ?

পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিশ্ব কখনো সম্পূর্ণভাবে সন্ত্রাসমুক্ত ছিল না। শক, হুন, দল, পাঠান, মোগল প্রমুখ বিভিন্ন শক্তি বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের যে নবাবী আমল নিয়ে আমরা এতো গর্ব করি, সেই আমলও হারমাদ, মগ ও বর্গী দস্যুদের সন্ত্রাসে জর্জরিত ছিল। বর্গীদের সন্ত্রাস নিয়ে একটি ছড়া তো এখনো মানুষের মুখে মুখে। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।’ নবাব আলিবর্দী তার শাসনামলের বেশি সময়টা কাটিয়েছেন বর্গী ও হারমাদ দস্যুদের সন্ত্রাস দমনে। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশ বা ভারত কি সন্ত্রাসমুক্ত ছিল? পাঞ্জাব থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ইংরেজবিরোধী শক্তিশালী সন্ত্রাসী আন্দোলন তখন দেখা দিয়েছিল। অবিভক্ত বাংলায় অনুশীলন ও যুগান্তর পার্টি নামে সন্ত্রাসী দলের ব্যাপক সন্ত্রাসের কথা কে না জানে? ইংরেজ শাসকরা তাদের ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে মহাত্মা গান্ধী দেশবাসীকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তৎকালীন কংগ্রেসের বহু নেতাকর্মী ব্রিটিশবিরোধী ব্যাপক নাশকতামূলক (সন্ত্রাস) কাজে লিপ্ত হন। রেললাইন তুলে ফেলা, থানা, ডাকঘর, সরকারী অফিসে আগুন দেওয়া, ব্রিটিশ রাজকর্মচারী হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসমূলক কাজ সারা ব্রিটিশ-ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কীলিং’! অনেকে বলেন, এমন ভয়াবহ ও ব্যাপকভাবে সংঘটিত সন্ত্রাস ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর কখনও দেখা যায়নি। ঢাকা শহর ব্রিটিশ আমলেও সন্ত্রাসমুক্ত ছিল না। একটানা ত্রিশ বছর ঢাকা ছিল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নগরী। আজ ওয়ারী বা রায়ের বাজারে একজন মুসলমান ছুরিকাহত হলে পরদিন নবাবপুর বা ইসলামপুরে দু’জন হিন্দুর ছুরিকাহত হওয়া ছিল অনিবার্য। ঢাকার হিন্দুপাড়ায় হিন্দুরা সহজে শহরের মুসলিম এলাকায় যেতেন না, আবার মুসলমানেরা হিন্দু এলাকার দিকে পা বাড়াতেন না। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ঢাকা শহরে এই অবস্থা বিরাজিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও কি বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সন্ত্রাসমুক্ত ছিল? মোটেই ছিল না! উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যে অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। কমরেড পি,সি, যোশীর বদলে উগ্রবাদীরা নেতৃত্ব দখল করেন এবং কম্যুনিস্ট পার্টি ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়’ সেøাগান তুলে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের (আসলে সন্ত্রাস) মাধ্যমে সরকার উচ্ছেদের ডাক দেয়। শুরু হয় থানা লুট, পুলিশের ওপর হামলা, রেল চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি, গ্রামাঞ্চলে ধনী জোতদারদের ওপর অতর্কিত হামলা, তাদের গোলার ধানপাট লুট ইত্যাদি। তখন পশ্চিমবঙ্গে এবং পূর্ব পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল সন্ত্রাসী দল হিসেবে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে কম্যুনিস্ট-সন্ত্রাস জনমনে ভীতি সৃষ্টি করলেও শাসকশ্রেণী তা থেকে ফায়দা লুটেছিল। কম্যুনিস্টদের সন্ত্রাসকে তারা নাম দিয়েছিল ঝঁনাবৎংরাব ধপঃরারঃরবং বা ধ্বংসাত্মক কাজ। এই ধ্বংসাত্মক বা নাশকতামূলক কাজে কেউ জড়িত বলে সন্দেহ হলেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলে আটক রাখা হতো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার তাদের আট বছরের স্বৈরাচারী শাসনে তাদের বিরোধী পক্ষের হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে জেলে পুরে রেখেছিল। তাদের বিরুদ্ধে ছিল অপ্রমাণিত নাশকতামূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ। পাকিস্তানের শাসকেরা কোন গণদাবিই পূরণ করতে চাইতেন না। এই দাবিগুলো ‘শিশুরাষ্ট্র’ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কম্যুনিস্ট ষড়যন্ত্র এই ধুয়া তুলে তারা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোকেও নির্মমভাবে দমন করতেন। যেসব সন্ত্রাসে কম্যুনিস্টদের সংশ্রব ছিল না সেসব সন্ত্রাসেও কম্যুনিস্টদের হাত রয়েছে বলে প্রচার করে জনমনে একটা ‘কম্যুনিস্ট জুজুর’ ভয় সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ভৈরব ব্রিজের কাছে এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা হয়। তাতে তিনশ’র মতো যাত্রী নিহত হন। এই দুর্ঘটনার দায়িত্ব এড়ানোর জন্য তখনকার নূরুল আমিন সরকার ঘোষণা করেন, এটা কম্যুনিস্টদের ধ্বংসাত্মক কাজ; কিন্তু পরে সরকারী তদন্তেই প্রকাশ পায়, এটা ছিল সাধারণ দুর্বৃত্তদের কাজ। তারা রেললাইনের ফিশপ্লেট তুলে ফেলেছিল। এক সময় তৃতীয় বিশ্বের কোন কোন দেশে চলছিল বিদেশী শাসন অথবা স্বৈরচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা একে কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে তা নিষ্ঠুরভাবে দমনের ব্যবস্থা করে। আন্তর্জাতিকভাবেও তখন সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ তাদের বিশ্ব-আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সারাবিশ্বেই কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় ছড়াতে শুরু করে। কোন কোন দেশে কম্যুনিস্ট-সন্ত্রাসকে দশ গুণ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণাই সৃষ্টি করার চেষ্টা হয় যে, কমিউনিজমের দানব গোটা বিশ্বটাকেই তাদের লৌহ শাসনে বন্দী করার ফন্দি আঁটছে। আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা ‘স্বাধীন বিশ্বের’ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কম্যুনিস্ট দানবের বিরুদ্ধে লড়ছে। সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও ইমপেরিয়ালিজম শত্রুমুক্ত হলেও তাদের সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দেয়। কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে এবং ‘স্বাধীন বিশ্বকে’ (ঋৎবব ডড়ৎষফ) রক্ষার ধুয়া তুলে সারাবিশ্বে শোষণ ও আধিপত্য বজায় রাখার যে নীতিটি তারা অনুসরণ করছিল তা একটি ধাক্কা খায়। কম্যুনিস্ট দানব নেই তো কার বিরুদ্ধে, কাদের রক্ষার জন্য পশ্চিমাশক্তি-শিবির যুদ্ধ করবে? কম্যুনিস্ট রোখার নাম করে তারা বিভিন্ন সামরিক চুক্তি সংস্থা গড়ে তুলেছিল। নানা অজুহাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির বাজার রমরমা করে তুলছিল। আমেরিকার গোটা অর্থনীতি তো এখন বলতে গেলে নিত্যনতুন যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ এবং তার বিক্রির বাজার সম্প্রসারণের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ এবং ধনবাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং প্রয়োজনেই কম্যুনিস্ট জুজুর বদলে একটি নতুন জুজু সৃষ্টি করা দরকার হয়। যাকে হটানোর নামে বিশ্বে আবার যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা যায় এবং ধনবাদী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিরাট মুনাফার যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণশিল্প বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। সুতরাং নতুন শত্রু খোঁজা শুরু হয়। শত্রু যদি না থাকে, তাহলে তাকে তৈরি করতে হবে। নইলে বিশ্ব ধনবাদের শেষ আশ্রয় যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণশিল্প বাঁচবে না। এই শত্রু খোঁজার শুরু মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষা, মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদে একাধিপত্য বজায় রাখা, অঞ্চলটিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী স্বাধীনচেতা নেতাকে (যেমন নাসের, গাদ্দাফি) মাথা তুলতে না দেওয়া এবং অঞ্চলটিতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার গতি রোধ করার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই অঞ্চলটিতে ধর্মান্ধতা ও জিহাদিজম উস্কে দেয়। আফগানিস্তানের সেক্যুলার নাজিবউল্লা সরকারকে উৎখাতের জন্য কম্যুনিস্টরা নাস্তিক, খোদাদ্রোহী এবং ইসলামের শত্রু ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন নামে সশস্ত্র জিহাদিস্ট বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তালেবান, আল কায়েদা থেকে শুরু করে বর্তমানের আইএস পর্যন্ত সমস্ত জিহাদিস্ট গ্রুপের জন্ম আমেরিকার অর্থ, অস্ত্র ও প্রত্যক্ষ সাহায্য দ্বারা। আমেরিকার সাহায্যেই তালেবানরা আফগানিস্তানে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বেশ কয়েক বছর তাদের বর্বর শাসন চালাতে পেরেছিল। পরিস্থিতি বদলে যায় সোভিয়েট ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবিরের পতনের পর। বিশ্বের একক সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়ে আমেরিকার নিউকন্ বা নিউ কনজারভেটিভ শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতার দম্ভে মাথা ঠা-া রাখতে পারেননি। মধ্যপ্রাচ্যে জিহাদিস্ট গ্রুপগুলোর প্রয়োজন আমেরিকার কাছে তখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। এখন ইসরাইলের স্বার্থে এবং তেল সাম্রাজ্য রক্ষায় জিহাদিস্টদের কিছুটা দমন করা প্রয়োজন। তাই ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে নতুন করে অঞ্চলটিতে যুদ্ধের বিস্তার। যদিও এই যুদ্ধের সেøাগানটি ছিল জিহাদিস্টদের বিরুদ্ধে; কিন্তু প্রথমেই মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংস করা হয় ইরাক ও লিবিয়ার মতো দুটি সেক্যুলার রাষ্ট্রকে। আরও একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য ওয়াশিংটন তার মিত্র সউদি আরব ও ইসরাইলের সাহায্যে আইএস গঠন করে। পরবর্তী ধাপে টার্গেট ছিল ইরান। বিশ্ব পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে যাওয়ায় এখন নিজেদের সৃষ্ট আইএসের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধের মহড়া দেখাতে হচ্ছে। এই যুদ্ধও প্রকৃত যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের মহড়া। আমেরিকার আসল লক্ষ্য নয় সন্ত্রাসবাদের উচ্ছেদ বা আইএসের চূড়ান্ত পরাজয়। ইরাক ও সিরিয়ার তেল সমৃদ্ধ বিরাট এলাকা দখল করে আইএস রাজত্ব করুক এবং আমেরিকার অয়েল টাইকুুনরা এই আইএসের কাছ থেকে পানির দরে তেল কিনে বিশ্ববাণিজ্যে মজাছে বাণিজ্য করুকÑ এটা ওয়াশিংটনের আসল ইচ্ছা। প্রধান টার্গেট ইরানের মিত্র সিরিয়ার আসাদ সরকার। তাকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেয়া গেলে এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) রাজত্ব সম্প্রসারিত হলে ইরান একা হয়ে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ তো বাধানো গেছেই। এরপর ইরানকে ঘিরে সউদি নেতৃত্বে গড়ে উঠবে সামরিক চাপ সৃষ্টির বিরাট সুন্নি বলয়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের মতো সেখানে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। আমেরিকা দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখবে। ইরানকে বলবে তোমার পাশে আছি। কিন্তু প্রত্যক্ষ মদদ যোগাবে ইরানবিরোধী সুন্নি রাষ্ট্র গোষ্ঠীকে। এই গোষ্ঠীরই নতুনভাবে উদ্বোধন হয়েছে সউদি নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী নতুন এ্যালায়েন্স গঠনের মাধ্যমে। এটি আমেরিকার ইচ্ছায় চালিত হবে। বিশ্ব ধনতন্ত্র এবং তার নেতা আমেরিকার ইচ্ছা নয় বিশ্ব থেকে সন্ত্রাস বা তথাকথিত জিহাদিস্টদের উচ্ছেদ। ধনতন্ত্রের বাঁচার স্বার্থেই এবং মারণাস্ত্র শিল্পের মার্কেট রক্ষার জন্যই তাদের একটি শত্রুপক্ষ দরকার। কম্যুনিস্টদের বদলে তাই জিহাদিস্ট শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। আগে যেখানে কারণে-অকারণে কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় দেখানো হতো, এখন সেখানে দেখানো হচ্ছে জিহাদিস্ট জুজুর ভয়। আইএসের শক্তি যতটা তার চাইতে বড় করে দেখানো হচ্ছে। আবার এই আইএসকে পরাজিত করার জন্য রাশিয়া সামরিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে গেলে আমেরিকাই তাতে নানা অজুহাতে বাধা দেয়। তাঁবেদার রাষ্ট্র তুরস্ককে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। এক শ্রেণীর নিরপেক্ষ মার্কিন পর্যবেক্ষক আজকাল সত্য কথাই বলেন যে, একটি দুর্বল প্রতিপক্ষকে সবল শত্রুপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকাই এখন সারাবিশ্বে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে। আগেও বিশ্বে বর্তমান সন্ত্রাসের চাইতেও বড় সন্ত্রাস ছিল। কিন্তু তখনকার ভৌগোলিক বাধা, আধুনিক প্রচার ও প্রযুক্তি শক্তির অভাবে তা কখনো আঞ্চলিকতার গ-ি ডিঙাতে পারেনি। কিন্তু পৃথিবী এখন ছোট হয়ে গেছে। এবং যে কোন ধরনের সন্ত্রাস মাওবাদী থেকে জিহাদিস্ট, সব কিছুই সহজে গ্লোবাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। জিহাদিস্টদের এই দাঁড়ানোর কাজে প্রচারণাশক্তি যোগাচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোই। যেখানে যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, পশ্চিমা মিডিয়া প্রথমেই তাতে আইএসের গন্ধ খোঁজে। পশ্চিমা মিডিয়ায় এখন সংবাদ, ফিচার সব কিছুতেই প্রাধান্য পাচ্ছে আইএস। অনেকের ধারণা, আইএস এখন পর্যন্ত টিকে আছে এই পশ্চিমা প্রচারণার জোরেই। বাংলাদেশে আইএসের তেমন অস্তিত্ব নেই। দেশটিতে প্রধান সন্ত্রাসীশক্তি জামায়াত এবং তাদের উপদলগুলো। জেএমবি থেকে হিজবুত তাহরির পর্যন্ত। কিন্তু বাংলাদেশে দু’জন বিদেশী নাগরিক সম্প্রতি সন্ত্রাসের বলি হতেই আমেরিকাই প্রথম এটা আইএসের কাজ বলে প্রচার চালায়। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে তা প্রমাণিত হয়নি। বরং সন্দেহ করা চলে এটা বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর আগের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ধারাবাহিকতা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- বানচাল করার জন্য এ সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল। আমেরিকা এই আসল সন্ত্রাসীদের চেহারা আড়াল করার জন্যই কি বাংলাদেশে কল্পিত আইএস শত্রুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে চেয়েছিল? গত শতকে কম্যুনিস্টরা একটা গ্লোবাল শক্তি ছিল। বর্তমান জিহাদিস্টরা মোটেও গ্লোবাল শক্তি নয়। পশ্চিমা শক্তি ও মিডিয়া তাদের প্রচারণা দ্বারা জিহাদিস্টদের গ্লোবাল শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই একটি শত্রুপক্ষ দরকার। কম্যুনিস্ট-শিবির নেই। তাই জিহাদিস্টদের তার স্থানে বসানো হয়েছে। এবং তার বিরুদ্ধে ডনকুইকজোটের মতো পশ্চিমা শক্তি শিবির যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় রত। এই খেলার অবসান হতে পারে এবং আইএসের অস্তিত্ব লুপ্ত হতে পারে যদি আমেরিকা নিজে তার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাত গুটায় এবং কোন কোন দেশে রেজিম চেঞ্জের জন্য অকারণ আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধিয়ে রেখে সন্ত্রাস ও হানাহানিকে প্রশ্রয় না দেয়। বিশ্বব্যাপী আধিপত্যবাদী সন্ত্রাস চালাতে গিয়ে আমেরিকা নিজের ঘরেই বিশ্বনিন্দিত বুশ নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছিল। বিশ্বের বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য বুশনীতি সর্বাধিক দায়ী। বুশ আমলের কালিমামুক্ত হওয়ার আগেই আমেরিকা কি চায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক ফ্যাসিবাদী ব্যক্তি ক্ষমতায় বসুক আমেরিকায়? তা যদি হয় তাহলে আমেরিকাকে কেউ ধ্বংস করবে না; আমেরিকা নিজের পাপের ভারেই ধ্বংস হতে পারে। লন্ডন, ২১ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ২০১৬।
×