ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার বহিরঙ্গের জীবন এবং অপ্রকাশ্য সংগ্রামী জীবন- দুটোর ভেতর ব্যবধান প্রচুর। গত সপ্তাহের প্রকাশ্য ঢাকা জীবনের কথা বলতে গেলে আমরা বলতে পারি অন্তত দুটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কথা। হাজারিবাগে ট্যানারি কারখানা অপসারণের নোটিস দেয়া হয়েছে। ট্যানারি বর্জ্য ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গার কী বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে সেকথা বহুবার কাগজে লেখা হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতির কারণে এলাকাবাসীও ক্ষতিগ্রস্ত। অপরদিকে ঢাকার পাঁচটি আবাসিক এলাকার (ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরা ও বারিধারা) অবৈধ ও বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হচ্ছে অচিরেই। এ দুটি খবর সচেতন নগরবাসী মাত্রেই জানেন। কিন্তু পাশাপাশি ঢাকায় অপ্রকাশ্য যে সংগ্রামী জীবন বহতা রয়েছে তার খবর আমরা তেমন রাখি না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে যে ছেলেটি বছরের পর বছর চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছে, তার গভীর কষ্টের কথা ঢাকা কি বুকে ধরে রেখেছে? মিশন ক্লিন ঢাকা ঢাকায় এবার জোরেশোরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলার কথা বলা হচ্ছে। কিছু কিছু নমুনা দেখতেও পাচ্ছেন নগরবাসী। জেনেবুঝে কিংবা অসতর্কতার বশে বিপুল সংখ্যক নগরবাসী প্রতিদিনই তার বসবাসের শহরকে নোংরা করছেন। রাস্তার ওপর কখনোই কিছু ফেলব না- এরকম একটা প্রতিজ্ঞা যদি শুধু শিক্ষিত নাগরিকরাই নেন তাহলেও ঢাকার প্রতিদিন ঢাকা অর্ধেক না হলেও অনেকখানি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। মেয়রদ্বয় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক। ফেসবুকে মাহমুদুর রশীদ তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘মোহাম্মদপুরের রাস্তায় হঠাৎ দেখি নানাবিধ কলকবজা বিশিষ্ট এক নতুন যান। জটলার ফাঁকে দেখলাম এক নতুন পরিষ্কারক যান যেটি শুধুমাত্র ম্যানহোল ওপেন করে ভেতরে পাইপ ঢুকিয়ে দেয় এবং প্রচ- প্রেশারে নালাগুলোর প্রতিবন্ধকতা দূর করে একে সচল রাখে। ছবি নিলাম। কারণ ঢাকা মহানগর উন্নত দিকে যাচ্ছে ভেবে মনটা খুবই পুলকিত হলো।’ ক্ষতিসাধনে প্রসাধনী গত সপ্তাহে রাজধানীর কয়েকটি বেকারি ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জরিমানা গোনার কথা লিখেছিলাম। তারা কাপড়ের রং মিশিয়ে দই-মিষ্টি লাড্ডু তৈরি এবং কাপড়ে ব্যবহার করার বিষাক্ত রং আবার ঘি ও বনস্পতি তেলে মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করত। সৃজনশীলতায় বাঙালীর তুলনাহীনতার আরেকটি পরিচয় মিলেছে এ সপ্তাহে। কসমেটিকস বা প্রসাধনী তৈরি করা হচ্ছে আটা, চক পাউডার, হলুদের গুঁড়া দিয়ে। চকবাজারে হানা দিয়ে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ জনৈক শাহীনের ওই ম্যাজিক কারখানার সন্ধান পান এবং নকল ও ভেজাল প্রসাধনীসামগ্রী জব্দ করেন। পুরনো ঢাকায় এ জাতীয় পুরনো পাপির সংখ্যা খুব কম হবে না। কালেভদ্রে দু-চারজন শাহীন ধরা খেলে আমাদের নতুন করে বোধোদয় ঘটে। জমে উঠেছে বাণিজ্যমেলা দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মানোন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি নতুন বাজার খোঁজার প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে। এবারের বাণিজ্যমেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পৃথিবীর কোন দেশে কী চাহিদা আছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। সেই চাহিদা অনুযায়ী আমাদের দেশের কোন কোন পণ্য রফতানি বা উৎপাদন করা সম্ভব, প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব সে বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। বছরের শুরুতে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত বছর এই সময়টায় ছিল জ্বালাও-পোড়াও অপরাজনীতির চূড়ান্ত চেহারা। ফলে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই মেলা। এবার সেসব নেই। তাই প্রথম দিন থেকেই মেলা জমে উঠেছে। শুক্র ও শনিবার নাকি মেলায় দুই লাখ মানুষ এসেছেন! এমন দাবিই করেছেন সাংবাদিকদের কাছে মেলার সদস্য সচিব। তা হতেও পারে। শনিবার সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে বাংলামোটর মোড়ে দেখি বাসের সহকারী ‘বাণিজ্যমেলা বাণিজ্যমেলা’ বলে যাত্রীদের ডাকছেন। তাতে হুড়মুড় করে নারী-পুরুষ উঠছেনও। বাসটি চলে গেল। পরের বাসে উঠেও কয়েকজন তরুণ নেমে এলেন সেটি থেকে। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করলেন- না এই বাস বাণিজ্যমেলায় যাবে না। ঢাকা শহরে এখন দুই কোটি লোকের বাস। বাণিজ্যমেলার মতো আকর্ষণীয় একটি মেলায় ছুটির দিন এক-দেড় লাখ লোক হওয়া অস্বাভাবিক মনে হয় না। সবাই তো একই সময়ে যাচ্ছেন না! রাজধানীবাসীর বিনোদনকেন্দ্রের বড়ই অভাব। তাই যে কোন মেলাতেই প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে। বাণিজ্যমেলায় রকমারি পণ্য ছাড়কৃত মূল্যে পাওয়া যায়- এটা ক্রেতাদের টানে। বিশেষ করে মহিলা ক্রেতারা ঘর-গেরস্তালির পণ্য আর আসবাবপত্রের স্টলে বেশি ভিড় জমান। বাণিজ্যমেলায় বাণিজ্য হবে, সেটাই স্বাভাবিক; তবে এটি যে প্রাণোচ্ছল আনন্দময় এক মানব মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, সেটাও অনেক বড় বিষয়। যদিও কোন কোন খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে ‘গলা কাটার’ অভিযোগ উঠেছে। খান ফয়জুল নামে এক মেলাপ্রেমী ফেসবুকে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এভাবে : ৬ জানুয়ারি সপরিবারে বাণিজ্যমেলায় হাজীর বিরিয়ানি খেতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছি! বিফ বিরিয়ানি হাফ প্লেটের দাম ১৫০ টাকা হিসেবে পাঁচজনের জন্য অর্ডার করি! বিরিয়ানির গরুর মাংসের বর্ণনা না দেয়াই ভাল! সঙ্গে ছিল দুটো অখ্যাত ব্র্যান্ডের ছোট পানির বোতল আর সালাদ! ১০০০ টাকার নোট দেয়ার পর আমাকে ফেরত দেয়া হলো মাত্র ২০ টাকা! আমার হিসাবে যা ৭৯০ টাকা হওয়ার কথা! ওয়েটারকে বিল কপি দিতে বললাম, শেষে বিল দেখে চক্ষু একেবারে মাথার উপর! দুটো হাফ লিটার পানির বোতলের দাম ৬০ টাকা, ১৫% হারে ভ্যাট যোগ করে হয়েছে ৯৮৯ টাকা! ভ্যাটের টাকা চার্জ করেছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাটের চালান চাইতেই লাগল বিপত্তি, প্রথমে বলা হলো ভ্যাট চালানের কপি দেবে, একটু অপেক্ষা করতে হবে! আমি নিজেই কাউন্টারে গিয়ে আমার পরিশোধিত খাবারের মূল্যের ওপর ভ্যাটের চালানের কপি চাইলে বলা হয়, তাদের কাছে চালানের বইগুলো এখনও পৌঁছায়নি! আগামী কাল থেকে চালানের কপি দেয়া হবে। চালানের কপি দিতে পারবেন না তাহলে ভ্যাট আদায় করছেন কেন- জানতে চাইলে বলা হয়, এটি মালিককে জানাতে! বুঝলাম, এভাবে হবে না, দোকানের সামনে দু’জন পুলিশ সদস্যকে বিষয়টি অবহিত করলে আমাকে মেলায় স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে অভিযোগ জানাতে বলা হয়! পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কর্তব্যরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জনাব তোফাজ্জল সাহেবের সঙ্গে কথা বলি! তিনি সঙ্গে সঙ্গে দু’জন পুলিশকে সেখানে পাঠান! জানতাম কিছুই হবে না, ভ্যাটের নামে আদায়কৃত রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা এভাবেই ওদের পকেটে চলে যাচ্ছে, ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল! আজ ফেসবুকে আপডেট দেখে ভাল লাগল! মনে হলো সেদিন পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করে অভিযোগ জানানোটা সার্থক হয়েছে, অনেক মানুষের প্রতিবাদ আর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভ্যাট আদায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এভাবেই হোক প্রতিবাদ! ভ্যাট ইনটেলিজেন্স বা মূসক গোয়েন্দার এফবি পেজে পোস্ট দিয়ে বাণিজ্যমেলায় খাবারের স্টলে অনিয়মের অবসান হওয়ার তথ্যটি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে : ...দাম কমেছে হাজীর বিরিয়ানির! ...ভ্যাটও আদায় হচ্ছে! লাইনে আনা হয়েছে এর মালিককে। ...ইপিবিসহ অন্যান্য সংস্থাও সহযোগিতা করেছে। অনেক অভিযানে সাফল্যের পর আমাদের আরেকটি যুগপৎ অর্জন এটি। বলা দরকার, এবার দেশী-বিদেশী মোট ৫৫৩টি স্টল নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপসহ মোট ৫টি মহাদেশ অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ মেলায় অংশগ্রহণ করবে। বিদেশি ৫৪টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যমেলায় অংশ নিচ্ছে। তাদেরকে মোট ৫৬টি স্টল দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যমেলা আয়োজনের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পরিচয়ের সুযোগ সৃষ্টি বড় প্রাপ্তি। তাছাড়া এ আয়োজনে দেশীয় বাণিজ্যের বৃদ্ধিরও বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়। উৎপাদিত পণ্যের মান যাচাই করারও অবকাশ মেলে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের প্রচলিত ও অপ্রচলিত কৃষি পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজার খোঁজার একটি প্ল্যাটফরম হতে পারে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা, এমনটা আমরা ভাবতেই পারি। বিগত দুই বছরে বাণিজ্যমেলায় গড়ে ৮০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ পাওয়া গিয়েছিল। এবার তা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সংগীত সাধিকা সামিয়া ড. সামিয়া মাহবুব আহমেদ সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। থাকেন ওয়াশিংটনে। সেখান থেকেই উচ্চাঙ্গ ও নজরুল সঙ্গীতের এই সাধিকা শিল্পী পিএইচডি করেছেন সমাজবিজ্ঞানে। সামিয়া দিল্লীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন সুমিত্রা গুহর কাছে। তাঁর কথা বলছি এ কারণে যে আমেরিকা কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা- যেখানেই তিনি বসবাস করুন না কেন বাঙালী তরুণ সঙ্গীতপ্রেমীদের বাংলা সঙ্গীত ও সংস্কৃতি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। প্রবাসে তাঁর কাছ থেকে যারা গান শিখেছেন তারা বাংলা সঙ্গীতের পাশাপাশি বাংলা ভাষা চর্চার প্রেরণা লাভ করেন। ভয়েস অব আমেরিকাকে তাঁর একজন শিক্ষার্থী বলছিলেন শিক্ষিকা সামিয়ার এই গুণের কথা। ঢাকায় কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন সামিয়া এবার। তাঁর দুই সন্তানও গানের সঙ্গে যুক্ত। ইউটিউবে পুত্রের ক্ল্যারিনেট বাদন শুনে ভাল লেগেছে। ঘরোয়া আসরে সামিয়ার গান শোনার সুযোগ হলো। ঝিরঝিরে ঝর্নার মতো, বলা যায় নরম নদীর মতো শান্ত কণ্ঠ তাঁর। অথচ তার সুরধ্বনি যতদূর ধীরে বয় ততদূর যেন কেমন একটা গভীর রেশ রয়ে যায় শ্রোতার মনে। শিল্পী প্রমাণ করেছেন শাস্ত্রীয় ও নজরুল সংগীতকে তীব্র উচ্চকিত কণ্ঠবর্জিত কোমল সুরে পরিবেশন করেও শ্রোতার মনে সুখচিহ্ন রাখা সম্ভব। সাবলীলভাবে আকর্ষণীয় গায়কীতে তিনি নজরুলের জনপ্রিয় ও স্বল্পশ্রুত গান পরিবেশন করেন। নিজেকে শিক্ষিকা নয়, গানের শিক্ষার্থী বলতেই পছন্দ করেন সামিয়া। নম্র স্বভাবের মিষ্টভাষী সামিয়া ‘মাস্টার আর্টিস্ট’ উপাধি পেয়েছেন মেরিল্যান্ড স্টেট আর্টস কাউন্সিল থেকে। তিনি মনগমরি কাউন্টি কাউন্সিলের সংগীত বিচারক। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ে ওয়ার্কশপও করে থাকেন। ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ [email protected]
×