ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্ষোভ, অবরোধ যানজট

মৎস্য ভবন ও শাহবাগ এলাকায় বাস চাপায় দুই স্কুলছাত্রী নিহত

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

মৎস্য ভবন ও শাহবাগ এলাকায় বাস চাপায় দুই স্কুলছাত্রী নিহত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর শাহবাগ থানা এলাকায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ক্ষুদে মেধাবী স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত সাবিহা আক্তার সোনালী জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। সে জাতীয় শিশু একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত ও তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিল। এর কয়েক ঘণ্টা পরই কুমিল্লার লক্ষণপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া খাদিজা খাতুনের জীবন কেড়ে নেয় বেপরোয়া বাস। মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে ঘটনা দুটি ঘটে। দুই পরিবারে বইছে শোকের মাতম। বেপরোয়া গতির বাস স্বপ্ন কেড়ে নিল দুই শিক্ষার্থীর। সোনালীর মৃত্যুর ঘটনায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা। সোনালী নাচ, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত ও তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিল সে। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতেই চালক বাসের চাকায় পিষ্ঠ করে সোনালীর কঁচি শরীর রাস্তায় মিশিয়ে দিল। রক্তরাঙা হলো পিচঢালা কালো রাস্তা। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, স্থানীয়রা, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অন্তত এক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন। ব্যস! এই পর্যন্তই। এরপর সবই সোনালী অতীত। শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর শাহবাগ মডেল থানাধীন সুপ্রীমকোর্ট বার কাউন্সিলের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় একটি বেপরোয়া গতির বাস সোনালীকে (১৩) চাপা দেয়। এতে সোনালীর মাথা এবং কোমর পর্যন্ত রাস্তায় সঙ্গে পিষ্ঠ হয়ে অনেকটা মিশে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। নিথর দেহ পড়ে থাকে রাস্তায়। জনতা ধাওয়া করলে বাস ফেলেই চালক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলীগামী ৮ নম্বর পরিবহনের যাত্রীবাহী ঢাকা মেট্রো-জ- ১১-১৩২৮ নম্বরের বাসটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে সেগুনবাগিচার সোনালীর স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এসে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এমন বিক্ষোভে যোগ দেন স্থানীয় জনতাও। প্রায় এক ঘণ্টা চলে সেই অবরোধ। যানজটে পুরো রাজধানীর ওপরই প্রায় প্রভাব পড়ে। ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ঘটনার জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সোনালীর মামা জনতা ব্যাংকে কর্মরত এমদাদ হোসেন জিহাদ জনকণ্ঠকে বলেন, সোনালীর পিতা জাকির হোসেন (৪৫)। পেশায় রংমিস্ত্রি। মাতা কুলসুম খাতুন (৩৫) গৃহিণী। বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানাধীন ঝনঝনিয়া গ্রামে। মাসিক সাত হাজার টাকা ভাড়ায় পরিবারটি সুপ্রীমকোর্টের সামনে পূর্ত ভবনের পেছনের একটি ছাপড়া ঘরে বসবাস করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাস তাদের। স্বল্প আয়ের সংসার। সোনালীর একমাত্র বড়ভাই সাজ্জাত হোসেন সৈকত (১৬) নরসিংদী পলিকেটনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সোনালী সেগুনবাগিচা ২৭/৪ নম্বর তোপখানা রোডে অবস্থিত বেগম রহিমা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। স্কুলটির সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এইচ বারী জনকণ্ঠকে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণীতে সোনালী ভর্তি হয়েছিল। এ স্কুল থেকেই জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে নাচ, গান, আবৃত্তি, খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। শিশু একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত ও তালিকাভুক্ত গায়ক ও নাচিয়ে ছিল। অষ্টম শ্রেণীর পাস করার পর সে তেজগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য সুযোগ পেয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সোনালীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি আরও কোন সহযোগিতা করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। সোনালীর মামা আরও জানান, সোনালীকে চিকিৎসক বানানোর ইচ্ছে ছিল। বেসরকারী স্কুলে পড়াশুনার খরচ বেশি। অভাবের সংসার। তাই চান্স পাওয়ায় তাকে তেজগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির কথা ছিল। কারণ সরকারী স্কুলে পড়াশুনার খরচ কম। শনিবার ভর্তির জন্যই স্কুলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়। পূর্ব দিকের বাসা থেকে বেরিয়েই পশ্চিম দিকে অবস্থিত বার কাউন্সিলের দিকে যাওয়ার জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হচ্ছিল। এ সময় বেপরোয় বাস সোনালী পিষ্ঠ করে মেরে ফেলে। চালক ঘটনার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলছিল বলে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি জানান। দুপুরে সোনালীর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আজিমপুর কবরস্থানে সোনালীকে দাফন করা হয়। সোনালী এখন শুধুই সোনালী অতীত। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো মেধাবী ছাত্রী সোনালীর নামটিও। বেঁচে থাকলে হয়ত এই সোনালীই পরিবারের জন্য সোনালী ভবিষ্যতে বয়ে আনতে পারত রংমিস্ত্রি পিতার মনে আর পরিবারকে রঙিন করতে পারত। এখন সবই সোনালী অতীত। লাশ হলো খাদিজা ॥ সোনালীর মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষে ঢাকায় বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হলো কুমিল্লার মেধাবী ক্ষুদে স্কুলছাত্রী খাদিজা আক্তারকে (১২)। শনিবার বিকেল সোয়া তিনটায় শাহবাগ মোড়ে যাত্রীবাসী বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারায় সে। দুর্ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় খাদিজা আক্তারকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল সোয়া চারটার দিকে তার মৃত্যু হয়। খাদিজার বোনজামাই ওমর ফারুক জানান, দুই সপ্তাহ আগে খাদিজা কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মানদুয়ারা গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যান। ফেরার পথে তার শ্যালিকা খাদিজাকে বেড়াতে ঢাকায় নিয়ে আসেন। খাদিজা লক্ষণপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবার পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় লক্ষণপুর ফাজিল মাদ্রাসায়। শনিবার সকালে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকাসহ শ্যালিকা খাদিজাকে নিয়ে শাহবাগের শিশুপার্কে ঘুরতে আসেন। শিশুপার্কে ঘোরা শেষ হলে দুপুরের খাবার খেতে শাহবাগের দিকে যেতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় গাবতলী-যাত্রাবাড়ী রুটের ৮ নম্বর একটি বাস খাদিজাকে চাপা দেয়। বাসটি নিয়ে পালানোর সময় চালকসহ বাসটিকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। এর আগে গত সপ্তাহে বাসের ধাক্কায় শাহবাগ বারডেম হাসপাতালের সামনে এক কর্মী নিহত হন। প্রায় প্রতিদিনই বেপরোয়া যানবাহন কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। কোল খালি হচ্ছে অনেক মায়ের। সম্প্রতি যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামের একটি সংগঠন গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বলে দাবি করে। যদিও এমন তথ্য সত্য নয় বলে দাবি করেছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই সংখ্যা ৩৫৯ জন। এর মধ্যে রাজধানীতেই মৃত্যুর শিকার হন ২২৭ জন। হাইওয়ে পুলিশ বলছে, সারাদেশে ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। সড়ক মহাসড়কে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব সড়ক মহাসড়কে সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত প্রায় ২১ লাখ বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন চলাচল করে। যদিও বাস্তবে শুধু মহাসড়কেই প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। বিআরটিএর হিসাব মতে, সারাদেশে বৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। বাকি সবই অবৈধ। অবৈধ চালকদের মধ্যে কিশোর চালকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কোন প্রকার প্রশিক্ষণ না দিয়েই হেলপার থেকে আস্তে আস্তে চালক হওয়ার কারণে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। অবৈধ চালক ছাড়াও মাদক সেবন, অতিরিক্ত যাত্রী, বেপরোয়া গতি ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আশঙ্কাজনকহারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গার কারণেও প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, সারাদেশের মহাসড়কগুলোতে ২০৮টি ব্লাকস্পট (দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা) রয়েছে। এসব কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা বাড়ছে। ইতোমধ্যেই অনেক ব্লাকস্পট মেরামত করা হয়েছে। অনেক রাস্তার বাঁক সোজা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তুলনামূলকভাবে সড়ক দূর্ঘটনা কমছে না। এর অন্যতম কারণ, অতিরিক্ত যাত্রী, অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে অবৈধ চালক কর্তৃক যানবাহন চালানো। এছাড়া প্রতিটি সড়ক মহাসড়কের ওজন ধারণক্ষমতা রয়েছে। দেশের অধিকাংশ রাস্তার ওপর দিয়ে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী ও পণ্য নিয়ে যানবাহন চলাচল করে। ফলে দ্রুত রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার এটি আরেকটি কারণ। এক্ষেত্রে একটি সূক্ষ্ম কারসাজি রয়েছে। নিয়মানুযায়ী পণ্যবাহী পরিবহন কি পরিমাণ ওজন বহন করতে পারে, তা পরিবহনের গায়ে লিখতে হয়। এজন্য ট্রাকের গায়ে ৫ টন লেখা থাকে। অর্থাৎ ট্রাকটি ৫ টন মালামাল বহনক্ষম এবং এর বেশি মালামাল বহন করতে পারবে না। বাস্তবে এসব ট্রাক কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ টন মালামাল নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার আরেকটি কারণ। হাইওয়ে পুলিশের তরফ থেকে বিষয়টি মনিটরিং করার কথা থাকলেও অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা উৎকোচের বিনিময়ে এসব ট্রাককে অনায়াসে যাতায়াত করতে দেয়। এসব কারণে প্রতিবছর গড়ে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আর বছরে গড়ে অন্তত ২০ হাজার মানুষ আহত হন। আহতদের মধ্যে গড়ে অন্তত ৫ হাজার মানুষকে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। এদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সঠিক নিয়ম মেনে চললে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে বুয়েটের এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে।
×